অর্থনীতিবিদ থেকে প্রধানমন্ত্রী— ভারতে উদার বাজারনীতির রূপকার মনমোহন
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:২২ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:১১
বর্তমান পাকিস্তানে জন্ম, দেশের প্রথম অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। ভারতীয় অর্থনীতির এক বহু আলোচিত, বহু বিতর্কিত মহাসন্ধিক্ষণের জন্ম হয়েছিল তারই হাত ধরে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ভারতের উদার আর্থিক নীতির জনক হিসেবে স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি। সে সময় তিনি ছিলেন নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী।
মনমোহনের জন্ম ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের চকওয়াল জেলার গ্রাম গাহে। দেশভাগের সময় কিশোর মনমোহন বাবা গুরমুখ সিংহ এবং মা অমৃত কৌরের হাত ধরে চলে আসেন অমৃতসরে।
চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে প্রথমে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন মনমোহন। শোনা যায়, ক্লাসে কখনও দ্বিতীয় হননি তিনি। তারপর পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক, ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ডি.ফিল করেন তিনি।
অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শেষে ভারতে ফিরে আসেন তিনি। এরপর রাষ্ট্রপুঞ্জের চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত একটানা রাষ্ট্রপুঞ্জের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শাখায় কাজ করেন।
১৯৬৯ সালে মনমোহন শুরু করেন শিক্ষকতা। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে যোগ দেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য সরকারি দায়িত্বের সূচনা ঘটে তার জীবনে। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন তিনি। ১৯৭৬ সালে হন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসচিব। ১৯৮০ সাল থেকে টানা দু’বছর মনমোহন ছিলেন যোজনা কমিশনে। সে সময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
১৯৮২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেই পদেই কর্মরত ছিলেন। এরপর দুই বছর (১৯৮৫-৮৭) তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন হিসেবে কাজ করেন।
১৯৮৭ সালে অর্থনীতি বিষয়ক স্বাধীন সংস্থা সাউথ কমিশনের মহাসচিব পদে বসেন মনমোহন। যার সদর দফতর সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায়। সেখানেই ১৯৯০ পর্যন্ত ছিলেন মনমোহন। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে আসেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৯১ সালের মার্চে তিনি ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশন (ইউজিসি)-র চেয়ারম্যান পদে বসেন।
১৯৯১ সালের জুন মাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও তার সরকারে মনমোহনকে অর্থমন্ত্রী করেন। স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে এটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। এরপর থেকেই দিক পরিবর্তন করতে থাকে ভারতের আর্থিক নীতি বা বাজারনীতি। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার পর কংগ্রেসের হয়ে প্রথম বার রাজ্যসভা সদস্য নির্বাচিত হন মনমোহন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান তিনি। ১৯৯৯ সালে একবার লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জিততে পারেননি।
২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর কংগ্রেস সরকার তৈরি করার মতো অবস্থানে পৌঁছায়। কিন্তু ‘বিদেশিনী’ বিতর্কের আবহে প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। বিকল্প হিসেবে সামনে আসে মনমোহন এবং প্রণবের নাম। কংগ্রেস সভানেত্রীর সমর্থন ছিল মনমোহনের দিকে। শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করেন মনমোহন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে,তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ২০০৮ সালে বামেদের বাধা উপেক্ষা করে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। সিপিএম-সহ বাম দলগুলোর বিরোধিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। আস্থা ভোটে কোনোক্রমে রক্ষা পায় মনমোহনের সরকার।
২০০৯ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনে আসনসংখ্যা আরও বাড়িয়ে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন মনমোহন। সেই সরকারে রেলমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে বাংলা জয়ের পর মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতে মমতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ছাড়েন। তৃণমূলের অন্যান্যরা অবশ্য মন্ত্রিসভায় থাকেন। কিন্তু খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে সায় দেওয়ায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহনের সরকার ছেড়ে বেড়িয়ে আসে তৃণমূল। মনমোহন অবশ্য নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়েননি।
২০১৪ সালের গোড়ায় মনমোহন ঘোষণা করেন, তিনি তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্ব করবেন না। ২৬ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছেড়ে শেষ বারের মতো বেরিয়ে যান মনমোহন। সেদিনই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদি।
সারাবাংলা/এসডব্লিউ