১১ কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করবে বিএসইসি
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৩০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৮
ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১১টি কোম্পানির কারখানা, অফিস, আর্থিক হিসাব এবং ব্যবসায়িক অন্যান্য কার্যক্রম তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একইসঙ্গে কোম্পানিগুলোর মধ্যে নয়টির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), একটির পুনঃপ্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আরপিও) এবং একটির রাইট শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের ব্যবহার খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে বিএসইসি পৃথক পৃথক আদেশ জারি করেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। বিএসইসির জারি করা আদেশ কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) বরাবর পাঠানো হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানিগুলোর জন্য পৃথক পৃথক তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাদের ৩০ ও ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে কোনো অসঙ্গতি করেছে কি-না তা খতিয়ে দেখবে।
বিএসইসি যেসব কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করবে সেগুলো হলো- আমরা নেটওয়ার্ক লিমিটেড, বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড, ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড, লুব-রেফ বাংলাদেশ লিমিটেড, নাভানা ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেড, রিং সাইন টেক্সটাইলস লিমিটেড, বাংলাদেশ শপিং করপোরেশন লিমিটেড, শিকদার ইন্সুরেন্স লিমিটেড, সিলভা ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড এবং একটিভ ফাইন কেমিক্যাল লিমিটেড।
তথ্য মতে, বিগত সরকারের আমলে আইন লঙ্ঘন করা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত বিএসইসি পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অসঙ্গতি খুঁজে বের করতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
বিএসইসির আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন মনে যে, পুঁজিবাজার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থে কোম্পানিগুলোর কারখানা, প্রধান অফিস, আর্থিক হিসাব বই ও রেকর্ড এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নথিপত্র পরিদর্শন সাপেক্ষে যাচাই করা প্রয়োজন। তাই, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রুলস, ২০২০ এর রুল ১৭ এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কমিশন কোম্পানিগুলোর জন্য প্রথক পৃথক তিনজন করে কর্মকর্তাকে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হলো। পরিদর্শক কর্মকর্তারা এই আদেশ জারির তারিখ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন এবং পরিদর্শন প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেবেন।’
কোম্পানিগুলো যারা তদন্ত করবেন
- আমরা নেটওয়ার্কের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বিএসইসি উপ পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান রনি ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মিনহাজ বিন সেলিম।
- বেস্ট হোল্ডিংসের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন অতিরিক্ত পরিচালক ফারুক হোসেন, সহকারী পরিচালক আরাফুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক আব্দুল বাতেন।
ইনডেক্স এগ্রোর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন যুগ্ম পরিচালক রাশিদুল আলম, সহকারী পরিচালক ইব্রাহিম আলী ও সহকারী পরিচালক রায়হান কবির। - জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিটের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন উপ- পরিচালক মোহাম্মদ আসিফ ইকবাল, সহকারী পরিচালক ফারজানা ওয়ালিয়া ও সহকারী পরিচালক আসমাউল হুসনা।
- লুব-রেফ বাংলাদেশের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন অতিরিক্ত পরিচালক সাইফুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক তন্ময় কুমার ঘোষ ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রুমান হোসেন
- নাভানা ফার্মাসিটিক্যালসের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন উপ- পরিচালক জিয়াউর রহমান, সহকারী পরিচালক রুবেল হোসেন ও সহকারী পরিচালক শাকিল আহমেদ।
- রিং সাইনের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক তারিকুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক অমিত অধিকারী।
- বাংলাদেশ শপিং করপোরেশনের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আল মাসুম মৃধা, সহকারী পরিচালক মোসাব্বির আল আসিক ও সহকারী পরিচালক মেহরান আলী।
- শিকদার ইন্সুরেন্সের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন অতিরিক্ত পরিচালক ইউসুফ ভুইয়া, সহকারী পরিচালক শারিফুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক আনোয়ারুল আজিম।
- সিলভা ফার্মাসিটিক্যালসের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন উপ-পরিচালক আব্দুস সেলিম, সহকারী পরিচালক আজিজুর রহমান ও সহকারী পরিচালক বিনয় দে।
- একটিভ ফাইন কেমিক্যালসের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আল মাসুম মির্ধা, উপ পরিচালক মো. নানু ভূঁইয়া এবং সহকারী পরিচালক এ কে এম ফারুক আলম।
গঠিত তদন্ত কমিটি যেসব বিষয় খতিয়ে দেখবেন
- যেখানে সঠিক নথির মাধ্যমে এবং কমিশনের বিধান অনুসারে আয় ও ব্যয় নিশ্চিত করা হয়েছে কি না। সেইসঙ্গে যাদের সঙ্গে লেনদেন হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত ও লেনদেনের নগদ প্রবাহ এবং সেই বিনিয়োগগুলোর ন্যায্য মূল্যায়ন করা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন যাচাই করা। আইএএস ২৪ অনুযায়ী কোনো সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে লেনদেন থাকলে চিহ্নিত করতে।
- আইপিও বা আরপিও বা রাইট শেয়ারের অর্থের কোনো নয়-ছয় হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে রাইট শেয়ারের অর্থ যে খাতে ব্যবহার করার কথা ছিল সেখানে ব্যবহার হয়েছে কি না এবং কমিশনের কাছে সময় সময় জানানোর বিষয়ে আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই করা। এছাড়া সবধরনের লেনদেনের মধ্যে ছোট নগদ খরচ ব্যতীত অন্যান্য চেক বা ব্যাংকে স্থানান্তরের মাধ্যমে করা হয়েছে কি না তা যাচাই করা। এছাড়া এই বিষয়ে অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক সমস্যা থাকলে তা যাচাই করা।
এছাড়া একটিভ ফাইন কেমিক্যালের বিষয়ে আরো বেশ কিছু তথ্য যাচাই করবে তদন্ত কমিটি। সেগুলো হলো-
- সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থে কোম্পানিটির করপোরেট গভর্নেন্স কোডের অধীনে বাধ্যতামূলকভাবে সেই নীতি মেনে চলেছে কিনা তা যাচাই করা হবে। সেইসঙ্গে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ, অডিট কমিটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইও, সিএফও এবং কোম্পানি সচিব সহ শীর্ষ ব্যবস্থাপনার ভূমিকা যাচাই করা হবে।
- কোম্পানিটির পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ নিশ্চিত করেছে কিনা। সেইসঙ্গে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনগুলো মূল্যায়ন করবে। যে কোম্পানি এতদিন কর্মক্ষমতা এবং আর্থিক অবস্থান সম্পর্কে সত্য তথ্য দিয়েছে কিনা। কোম্পানির রাজস্ব আয়, মুনাফা এবং ব্যয়ের প্রতিবেদনে কোনো অসঙ্গতি আছে কিনা তা যাচাই করা হবে। এছাড়া গত পাঁচ বছরে ইপিএস এবং লভ্যাংশ প্রদান যে কমেছে তা তদন্ত করবে এবং কারণ জানতে চাইবে।
- অন্যদিকে কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডারদের গত পাঁচ বছর যে লভ্যাংশ দিয়েছে তা ঠিকভাবে বিতরণ হয়েছে কি না এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি মেনে হয়েছে কি না তা যাচাই করবে। সেইসঙ্গে মুনাফার অপব্যবহার বা অন্য জায়গায় ব্যয় করা হয়েছে কি না তা যাচাই করবে।
- কোম্পানিটির বিগত পাঁচ বছরে সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে সমস্ত লেনদেন চিহ্নিত করবে এবং যাচাই করবে। কোম্পানি সময়সীমার মধ্যে এজিএম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ এবং শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে এর প্রভাব তদন্ত করবে। তদন্ত কমিটি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতা এবং নিয়ন্ত্রকের অন্যান্য নীতি পালন মূল্যয়ন করবে। কোম্পানিটিকে করপোরেট গভর্ন্যান্স কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট প্রদানকারীসহ বাইরের নিরীক্ষকদের কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কোম্পানির উদ্যোগ এবং বিএসইসির প্রবিধান মেনে চলা মূল্যায়ন করবে। এছাড়া তদন্ত কমিটি কোম্পানির সুশাসন এবং আর্থিক প্রতিবেদনের ঘাটতিগুলোর বিষয়ে কার্যকর সুপারিশ দেবে।
এসব বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক অন্যান্য কার্যক্রম তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বর্তমান কমিশন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।’
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম