আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:১২ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:১৮
ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদায়নকৃত দলবাজ, দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তাদের অনতিবিলম্বে চিহ্নিত করে যাদের চাকরিকাল ২৫ বছর হয়েছে তাদের অব্যাহতি প্রদান, ওএসডিকরণ, কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও সংযুক্তকরণের দাবি জানিয়েছে বিএনপি গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক কমিটি।
একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদ’ উল্লেখ করে কমিটি ওই সরকারের আমলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিবসহ বিভিন্ন স্তরে সচিব এবং সুবিধা পাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ করেছে ওই কমিটি।
রোববার (১৫ ডিসেম্বর) বিএনপি গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক কমিটি ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিল সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ এবং সাবেক সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেসুর রহমান বরাবর এসব সুপারিশ প্রস্তাব তুলে ধরেন।
এ সময় কমিটির সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, আমরা মূলত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ করেছি। এরমধ্যে স্বল্প মেয়াদে বলেছি যে, যারা আওয়ামী লীগ সরকারকে একদম ওতোপ্রতভাবে সহযোগিতা করেছে তাদেরকে সরাতে হবে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের নির্বাচনে যারা ভোট চুরি করেছে, ভোটাধিকার হরন করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মধ্যমেয়াদি সুপারিশে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে প্রশাসন ঢেলে সাজাতে বলা হয়েছে। সেখানে নির্বাচনের তিন মাস আগে মাঠ প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া ও তাদেরকে নিরোপেক্ষ হিসেবে প্রস্তুত করা। তিনি আরও বলেন, বিগত সরকার নিজেদের খেয়াল খুশিমত কর্মকর্তাদের নিয়োগ পদোন্নতি পদায়ন করেছে। সেখানে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছে। এজন্য সরকারকে যে কমিশন গঠন করেছেন সেজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এসকল বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ন্যায় বিচার দিতে হবে।
সুপারিশ প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও উপযুক্ত পদায়নের ব্যবস্থা, স্বৈরাচার সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে যে সকল সৎ, মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিন যাবত ওএসডি করে রাখা হয়েছে, কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে পদোন্নতি ও পদায়ন থেকে বঞ্চিত করে অবসর আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং যাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়েছে, সেসব পেশাদার কর্মকর্তাদেরকে অতি দ্রুত ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদান। ক্ষেত্র বিশেষে গ্রেড-১ প্রদানসহ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর অবৈধ, নৈশ ও ডামি ভোটের নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিতপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় নির্বাচনের সময়ে মাঠপর্যায়ে যেসকল দলবাজ, দুর্নীতিগ্রস্থ বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল তাদের (কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে দুর্নীতিদমন কমিশন আইন ও ফৌজদারী আইনের অধীনে মামলা রুজু করার ব্যবস্থা নেয়া, ভঙ্গুর প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা/বিশ্বাস পুনরুদ্ধার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এহেন দৃশ্যমান পদক্ষেপ অতীব জরুরি। গতিশীল ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক কার্যক্রম নিশ্চিতকরণে সিন্ডিকেট ভিত্তিক চেইন ভেঙে দেয়া, কোন কোন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, কর্পোরেশন/কর্তৃপক্ষ ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে যে সকল কর্মকর্তা পাঁচ বছর বা ততোধিক সময় ধরে কর্মরত থেকে একটি অলিখিত সিন্ডিকেট পদ্ধতির প্রচলন করেছে সে সকল কর্মকর্তাকে দ্রুত বদলির পদক্ষেপ গ্রহণ, তবে কৌশলগত পদসমূহ যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বিভাগ কিংবা অন্য কোন টেকনিক্যাল পদের কর্মকর্তাদের বদলির ধরনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ স্বীয় বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারবেন।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনকল্পে যুৎসই পদক্ষেপ গ্রহণ, গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে অদক্ষতা, দুর্নীতি, অন্ধ দলবাজি এবং তথাকথিত উন্নয়নের ফাঁকা বুলি প্রচারণায় স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দলকানা অন্ধ কর্মকর্তা/কর্মচারী জড়িত থাকায় প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা হারায়। প্রশাসনের সকল স্তরে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনকল্পে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে জনগণের সেবক এই মূল্যবোধ ধারণ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে এবং ব্যাপকভাবে যৌথসভা/সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মতবিনিময় সভা আয়োজনসহ যুৎসই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
স্বচ্ছতা ও জনআস্থা বৃদ্ধির প্রয়োজনে সার্বক্ষনিক তদারকি ও পরিদর্শনের ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জনআস্থা তৈরিতে অধঃস্তন অফিস ও নিজ নিজ অফিস নিয়মিত পরিদর্শন/পর্যবেক্ষণের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে- নিয়মিত জেলা, উপজেলা, বিভাগীয় অফিস এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের স্ব স্ব অধঃস্তন অফিস/সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক ভিত্তিতে নিয়মিত পরিদর্শন, কর্মকর্তা কর্মচারীদের পর্যবেক্ষণ ও সার্বক্ষণিক মনিটরিং এর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: গত ১৬ বছরের শাসনামলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করায় এবং এই সকল দুর্নীতি চিহ্নিত করে মূলোৎপাটনে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রশাসনের ওপর জনআস্থা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তাই প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃশ্যমানভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাৎক্ষনিক দায়ী ব্যক্তি/কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়/মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে জেলাভিত্তিক মনিটরিং সেল স্থাপন।
জেলা প্রশাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মাঠ প্রশাসন পুনর্বিন্যাস: নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষতার সাথে আয়োজনের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস আগে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (রিটার্নিং অফিসার), উপজেলা নির্বাহী অফিসার (সহকারী রিটার্নিং অফিসার), আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মেট্রোপলিটন সিটির পুলিশ কমিশনার, উপ-পুলিশ কমিশনারগণকে বদলি/পদায়ন করে মাঠ প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, প্রশাসনে সংঘটিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা।
এছাড়া পদায়ন নীতিমালা: মাঠ প্রশাসনে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, বিসিএস প্রশাসন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে পদায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদায়ন নীতিমালা নিশ্চিতকরণ, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিকট ন্যস্ত রাখা, পদায়ন নীতিমালায় কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে ও কেন্দ্রীয় দপ্তরে পদায়নের ক্ষেত্রে ভারসাম্য/সমতা বজায় রাখাসহ পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করা হয়।
সারাবাংলা/জেআর/এনজে/আরএস