সারা দেশে চাহিদা, তবু পাহাড়ি বাঁশের ব্যবসায় মন্দা
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০০ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০৩
রাঙ্গামাটি: একসময় রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা কর্ণফুলী পেপার মিলস (কেপিএম) কাগজকলের প্রধান কাঁচামালই ছিল পাহাড়ে উৎপাদিত বাঁশ। পাহাড়ি বাঁশ থেকে উৎপাদিত সেই কাগজ ছড়িয়ে যেত দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
কেপিএম তথা কর্ণফুলী কাগজের সেই জৌলুস এখন আর নেই। এখন তা কেবলই স্মৃতি। কর্ণফুলী কাগজকলেও আর আগের মতো বাঁশ থেকে তৈরি হয় না কাগজ। বেসরকারি বিভিন্ন শিল্প গোষ্ঠীর প্রভাবে কর্ণফুলী কাগজের কদর, বাজার দুই-ই কমেছে। পাহাড়ে উৎপাদিত বাঁশের পরিণতি তাইলে কী?
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, কর্ণফুলী মিলে চাহিদা কমে আসায় এখন এসব বাঁশ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বন-জঙ্গলে বেড়ে ওঠা এসব বাঁশের বিশেষ চাহিদাও রয়েছে। তবে এসব বাঁশে ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীদের। আবার সম্প্রতি এই বাঁশের ওপর শুল্কহার বাড়িয়েছে সরকার। এ কারণে বাজার ও ব্যবসায় কিছুটা মন্দা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বাজালি, ছোটিয়া, মুলি, টেংরা মুলি, ওরাহ, মিতিঙ্গা, ডলু, নলি, বাড়িওয়ালা, ছাতারবাটা ও কালিছড়ি জাতের বাঁশ উৎপাদন হয়ে থাকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির কাউখালী, কাপ্তাই, নানিয়ারচর উপজেলা ও জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ বাজারজাত করা হয়ে থাকে। এসব বাঁশ ফরিদপুর, ঢাকার সাভার ও সরাইল, কুমিল্লার দাউদকান্দি, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, নোয়াখালী, কক্সবাজারের টেকনাফ ও শেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
বন বিভাগ রাঙ্গামাটি অঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আর যেসব এলাকায় বাঁশ উৎপাদন, আহরণ ও বাজারজাত করার করা হয়ে থাকে তার মধ্যে রয়েছে— রাঙ্গামাটি সদর, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল, নাড়াইছড়ি, মাচালং, পশ্চিম লক্ষীছড়ি, পূর্ব লক্ষীছড়ি, বাঘাইহাট, শিজক পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি, রেংকার্য্য, ছোট মেরুং, বড় মেরুং, কবাখালী, তারাবুনিয়াা, ঘাগড়া, কাঁশখালী, ঘিলাছড়ি, মুবাছড়ি, কলমপতি, না ভাঙা, কাঁশখালী, উল্টাছড়ি, লংগদু, ইয়ারিংছড়ি, মাইনিমুখ, সাপছড়ি, মানিকছড়ি, হেমন্ত মোন, বসন্ত মোন, কাইন্দ্যা, ফুলগাজী, বাপেরছড়া, কুতুবদিয়া, ভার্য্যতলী, বারদপোলা, সাক্রাছড়ি, বহালতলী, ঘিলাছড়ি, ছোট মহাপুরমপুর, হাজাছড়ি, বুড়িঘাট, তৈ চাকমা, ক্যাঙ্গালছড়ি, লেমুছড়ি, চৌংড়াছড়ি, থলিপাড়া, নুনছড়ি, লক্ষীছড়ি, বানরকাটা, ছোট ধুরুং, জারুলছড়ি, দুল্যাতলী, ময়ূরখীল, দেবালছড়ি, গোইনছড়ি, রাঙাপানি, রাজবিলা, রাইখালী, রাজস্থলী, ধনুছড়ি, খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, রামগড়, মানিকছড়ি।
সম্প্রতি রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার কুতুকছড়ি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খালের মধ্যে পানিতে ভাসিয়ে শ্রমিকরা বাঁশের চালা আনছেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ সেই বাঁশ বেঁধে প্রক্রিয়াজাত করছেন। কেউ বাজারজাত করার জন্য কাঁধে করে বয়ে নিয়ে ট্রাক ভর্তি করছেন।
বাঁশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় উৎপাদিত বাঁশের চাহিদা থাকলেও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ফলে ব্যবসায় সুবিধা করে উঠতে পারছেন না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে বন বিভাগ এসব বাঁশে আগের চেয়ে শুল্কহার বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করেছে।
এ অবস্থায় বাঁশ ব্যবসায় খরচ বেড়েছে, কমেছে মুনাফা। ব্যবসায়ীরা লাভ করতে না পারায় তারা আবার স্থানীয় চাষিদের বাঁশের দাম দিচ্ছে কম। এতে চাষিরা বাঁশের ব্যবসায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। কমছে বাঁশের বাজার।
রাঙ্গামাটির কুতুকছড়ি এলাকার স্থানীয় পাইকারি বাঁশ ব্যবসায়ী আব্দুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাঙ্গামাটির বাঁশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমরা চাহিদা অনুযায়ী বাঁশ দিতে পারছি না। আগে যে প্রজাতির বাঁশে ২ টাকা করে শুল্কহার দিতাম, এখন সেটা ৪ টাকা করা হয়েছে। আবার কিছু বাঁশে ৭ টাকার জায়গায় ১৪ টাকা করে শুল্কহার নিচ্ছে বন বিভাগ। কিন্তু পাইকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমরা আগের চেয়ে বেশি দাম নিতে পারছি না।’
আব্দুল হক আরও বলেন, ‘আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পথে পথে চাঁদাবাজি কমেছিল। এখন আবার বেড়েছে। যেমন— শেরপুর যেতে আগে পরিবহণসহ মোট খরচ হতো এক লাখ টাকার মতো। এখন এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো লাগছে। আমরা তাই স্থানীয়দের কাছ থেকে বাঁশ কেনা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছি। আবার বাজার অনুযায়ী ন্যায্য দাম না পাওয়ায় প্রান্তিক চাষিরাও বাঁশ বাগান ছেড়ে অন্যান্য বাগান গড়ে তুলছেন।’
জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও উপবন সংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারা দেশেই পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় উৎপাদিত বিভিন্ন বাঁশের চাহিদা রয়েছে। এখন তো কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই প্রচুর বাঁশ যায় রাঙ্গামাটি থেকে। বাঁশ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আমরা আপাতত কোনো ত্রুটি-জটিলতা দেখছি না।’
শুল্কহার বাড়ানো নিয়ে বাঁশ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বন বিভাগের এই কর্মকতা বলেন, ‘শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে। কারণ আগে যে শুল্কহারটা ছিল, সেটা অনেক অনেক আগের। এই জন্যই সেটা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। দেশের জন্যও তো কিছু রাজস্ব দরকার।’
সারাবাংলা/টিআর
পাহাড়ি বাঁশ পাহাড়ে উৎপাদিত বাঁশ বন বিভাগ বাঁশের ব্যবসা রাঙ্গামাটি শুল্কহার