‘মিরিঞ্জা ভ্যালি’ যেন এক টুকরো পাহাড়ি স্বর্গ
১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০০ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৫৬
বান্দরবান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ি কন্যাখ্যাত বান্দরবান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকরা এখানে ছুটে আসেন পাহাড়, ঝিরি-ঝরনা, মেঘ আর সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির টানে। বান্দরবান জেলার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তারা। চিম্বুক, নীলগিরি, কেউক্রাডং, তাজিংডং, বগালেক, মেঘলা, প্রান্তিকলেক, স্বর্ণ মন্দির, রামজাদি ও নীলাচলে বিস্তৃর্ণ পাহাড়, আকাশ ও মেঘের মিতালী, ঝিরি-ঝরনা, রিজুক, শৈলপ্রপাত, বড় পাথর, দেবতাকুম, নাফাকুম, আমিয়াকুমসহ অসংখ্য ঝরনাধারা মানুষকে প্রকৃতির ভেতর অবগাহন করায়। এছাড়া ঝুলন্ত সেতু, ক্যাবলকারসহ নজর কাড়া মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পটের কারণে প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে বান্দরবানে মানুষের ঢল নামে। তবে এবার বান্দরবানের মায়াবী সৌন্দর্যে যোগ হয়েছে আরেকটি স্পট। সেটি হলো লামা উপজেলার ‘মিরিঞ্জা ভ্যালি’।
বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ ও বাংলার দার্জিলিংখ্যাত পাহাড়ি কন্যা বান্দরবানের এই মিরিঞ্জা ভ্যালিতে মেঘ ও পাহাড়ের মিতালী দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন হাজারো পর্যটক। এখানকার সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে শুভ্র মেঘের লুকোচুরি, সেইসঙ্গে মেঘের ওপর দিয়ে রৌদ্রের খেলা। সত্যিই যেন এক স্বর্গ! আসলেই তো এটি প্রাকৃতিক স্বর্গ! আর এই সবুজ স্বর্গের প্রাকৃতিক উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন ভ্রমণ পিয়াসী পর্যটকরা। ফলে মিরিঞ্জা পাহাড়কে কেন্দ্র করে লামা উপজেলায় খুলছে পর্যটন সম্ভাবনার আরেক দুয়ার।
যা আছে মিরিঞ্জায়
পর্যটকদের সেবা দিতে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স, মিরিঞ্জা ভ্যালি, মারাইংছা হিল, সানসেট, মেঘবেলা, ডেঞ্জার হিল, টপপয়েন্ট ভিউ, চুংদারবক, সবুজ দিগন্ত রিসোর্ট, মারাইংচা ওয়াইল্ডসহ বেশ কয়েকটি রিসোর্ট। এসব রিসোর্টের কটেজ, জুমঘর ও তাবুতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক রাত্রি যাপন করে প্রকৃতির খেলা উপভোগ করে। এছাড়াও রয়েছে সুখিয়া ভ্যালি, রিভার ভিউ, রিভার হিল, লাতং রিসোর্ট, মিরিঞ্জা রিছাংতং রিসোর্টসহ আরও কয়েকটি রিসোর্ট।
লামা বাজার ঘেঁষে বয়ে গেছে পাহাড়ি কন্যা স্রোতস্বীনি মাতামুহুরী নদী। চাইলে এই নদীতে নৌকায় ভ্রমণে যেতে পারেন পর্যটকরা। মাতামুহুরীর বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির যে অপার সৌন্দর্য, তা প্রত্যেক ভ্রমণপিয়াসীকে বিমোহিত করবে। মিরিঞ্জা ভ্রমণ শেষে চাইলে পর্যটকরা ঘুরে আসতে পারেন লামা শহর থেকে। এখানে লামা পৌরসভা কার্যালয়সংলগ্ন এলাকায় প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে গড়ে উঠেছে তংথমাং রিসোর্ট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। এসি এবং নন এসি রুম সার্ভিসসহ রয়েছে থাই, চাইনিজ ও হরেক রকমের বাংলা খাবারের ব্যবস্থা।
সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উঁচুতে মিরিঞ্জার রোমাঞ্চকর ও সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজের সমারোহ। সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটোছুটি করছে শুভ্র মেঘ। কখনো কখনো এক চিলতে মেঘ এসে দর্শনার্থীদের বুলিয়ে দিচ্ছে তার হিমেল পরশ। জুম ঘরের বারান্দায় বসে মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা যেকোনো পর্যটককে ভুলিয়ে দেবে তার বিগত দিনের সব ক্লান্তি। রাতের নিস্তব্দতায় সবুজ পাহাড়ের গা ছুঁয়ে বয়ে চলা ঝরনার কল কল ধ্বনি যেমন পর্যটকদের শিহরিত করে, ঠিক তেমনি ভোরের দিগন্ত বিস্তৃত সাদা মেঘের ভেলা পুলকিত করে তোলে তাদের মনকে।
মিরিঞ্জা ভ্যালিরর মালিক মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, দুই একর পাহাড়ের মধ্যে তিন-চারটি জুম ঘর তৈরি করে ‘মিরিঞ্জা ভ্যালি’ নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। প্রথমদিকে পর্যটক তেমন একটা না এলেও বর্তমানে সেই দৃশ্য আর নেই। এখন এখানে আসার ১০ দিন আগেই জুমঘর বুকিং দিতে হয়। জুমঘর ও তাবুতে ৪/৫ জন গ্রুপ করে থাকলে প্রকার ভেদে ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা করে ভাড়া পড়ে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘মিরিঞ্জা ভ্যালিতে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট না থাকায় লামা বাজার থেকে পর্যটকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনতে হয়। এতে প্রতিজনের তিন বেলার খাবার বাবদ ৬০০ থেকে ৬৫০টাকা গুনতে হয়। এমনকি পানির সোর্স না থাকায় প্রতিদিন ট্যাংক ভর্তি পানি গাড়িতে এনে মজুদ করে রাখতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার দেখাদেখি মিরিঞ্জা ভ্যালির প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে ছাপ্পান্নটি কটেজ।’
যেভাবে আসবেন এখানে
কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকরা দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারবেন লামার ‘মিরিঞ্জা ভ্যালি’, ‘সানসেট’ কিংবা ‘ম্যারাইনছা হিলে’। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে নিজের বাইক কিংবা বড় বাহন নিয়ে সরাসরি আসতে পারেন মিরিঞ্জা হিলে। বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকেও সহজেই এখানে আসা যায়। ঢাকা থেকে রাতে সরাসরি লামা-আলীকদমের গাড়িতে রওনা দিয়ে ভোরে লামা মিরিঞ্জা এলাকায় নামতে হবে। এছাড়া, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চকরিয়া নেমেও যাত্রীবাহী বাস কিংবা জিপে করে আসা যায়। তবে আসার আগে পছন্দের রিসোর্ট বুকিং দিয়ে আসতে হবে।
যা বলছেন পর্যটক ও স্থানীয়রা
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকদের অনেকেই বলেন, এখানকার সবুজ প্রকৃতি আর শুভ্র মেঘের দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ। এখানকার পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত যে মেঘ দেখা যায় তাতে মনে, হয় এটা বাংলার দার্জিলিং। তবে এখানে অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে রিসোর্টগুলো একটু দূরে। আর রাস্তাগুলোও মাটির এবং ঢালু। ফলে যাত্রী নিয়ে কোনো গাড়ি রিসোর্ট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ফলে পায়ে হেঁটে পর্যটকদের কটেজ ও জুম ঘরে যেতে হয়। তাই এই ভ্যালিতে গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ করা দরকার বলে মনে করছেন তারা।
লামা উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম ও তানফিজুর রহমান জানান, বান্দরবানের লামায় পর্যটন ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উপরে এই মিরিঞ্জা ভ্যালির অবস্থান। সুতরাং এটাকে পর্বতও বলা যায়। এতদিন কারও কাছে এই উঁচু পর্বত চূড়ার কদর ছিল না। কয়েক বছর আগে মিরিঞ্জার নান্দনিক দৃশ্যটি স্থানীয়দের নজরে আসে। বছর খানেক আগে সেখানকার কিছু স্থানীয় যুবক তিন চারটি কটেজ বানিয়ে শুরু করেন পর্যটন ব্যবসা। এখন মিরিঞ্জা ভ্যালিকে ঘিরে বিভিন্ন নামে প্রায় ছাপ্পান্নটি কটেজ-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ফলে এই স্পটকে ঘিরে লামায় কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
লামা উপজেলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিরিঞ্জা একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পানি, বিদ্যুৎ ও রাস্তার ব্যবস্থাসহ পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশের ব্যবস্থা করা হবে।’
বর্তমানে বান্দরবান জেলায় মারমা, ত্রিপুরা, মুরুং, বম, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমি, খেয়াং, পাংখোয়া, চাকমা, চাক, লুসাই, বাঙালিসহ ১২টি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। দেশের অন্য কোনো জেলায় এত সম্প্রদায়ের বসতি নাই। পাহাড়িদের জীবন বৈচিত্র্য মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে তোলে। বান্দরবানে রয়েছে পাহাড়ের পর পাহাড়। দিগন্তজোড়া আকাশের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ি সমুদ্র। তাই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে মানুষের ঢল নামে।
সারাবাংলা/পিটিএম