পালটে গেছে তাদের জীবন
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৫ | আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:১৫
ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ নগরীর বলাশপুর আবাসনের পান্না, গোহাইলকান্দি মীর বাড়ির শাহানাজ, র্যালির মোড় ইসলামবাগের নাছিমা, বলাশপুরের স্বপন সেন, আব্দুল মোতালেব, গোহাইলকান্দি খালপাড়ের বিউটি আক্তার কিংবা আকুয়া জুবলী কোয়াটার এলাকার কিশোরী রিয়া। অর্থবিত্ত থেকে শুরু করে সামাজিক অবস্থান— সব দিক থেকেই তারা পিছিয়ে পড়া মানুষ। এগিয়ে যাওয়ার পথ যেন রুদ্ধ। স্বাভাবিক জীবনও যেন তাদের কাছে দুর্লভ।
কয়েক বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে এমন চিত্র। কাউন্সেলিং ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে নানা বাস্তবতায় পিছিয়ে পড়া এসব মানুষও এগিয়ে এসেছেন জীবনের লড়াইয়ে। কেউ হয়েছেন উদ্যোক্তা, কেউ হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা এগিয়ে নিয়েছেন নিজেদের জীবন, অবদান রাখতে শুরু করেছেন অন্যদের জীবনে, সমাজে। এখন সমাজের কাছেও তৈরি হয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা।
বেসরকারি সেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইইডি) সংস্পর্শ বদলে দিয়েছে এসব মানুষের জীবন। নেটওয়ার্কিং, অ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন আর কর্মোন্মাদনায় দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরণের পথে।
দিন বদলের এই তালিকায় রয়েছেন নারীরাও। একটা সময় পর্যন্ত যাদের ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হতো, শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না, তারাও এখন পা বাড়িয়েছেন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার দিকে। পিছিয়ে থাকার দিনের দিকে আর পিছু ফিরতে চান না তারা।
বলাশপুর আবাসনের পান্না বলেন, আইইডির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি অনেকদিন। তবে গত এক বছরে আইইডি সব কাজে অংশগ্রহণের ফলে আমার বেশকিছু পরির্বতন হয়েছে। আমি এখন আমার নিজের দল পরিচালনা করতে পারি, আমি নিজেকে একজন আদর্শ নেতা মনে করি। সামাজিক কাজ থেকে শুরু করে দলের সব সদস্যের সঙ্গে কাজ করি, নেতৃত্ব দেই। সবাই আমার কথা শোনে। পরিবারে, দলে, সমাজে আমার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।
র্যালির মোড় ইসলামবাগের নাছিমা জানান, সংস্থাটির সব কাজে অংশ নেওয়ার ফলে আমি এখন নিজেকে ক্ষমতায়িত মনে করি। কারণ আমি সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি। এখন আমার গ্রহণযোগ্যতা আছে, আমার সম্মান-মর্যাদা আছে। সমাজের সব কাজে নেতৃত্ব দেই। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন আমি নিজেই পরিচালনা করি।
যে ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইইডি) প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ সেটি মূলত একটি বেসরকারি সেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা। গণতন্ত্রায়ন এবং জন ও পরিবেশ সহায়ক সমাজ রূপান্তরের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে কাজ করছে। আইইডি ময়মনসিংহ আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক নুরুন্নাহার বেগম বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় কার্যক্রম চলমান। আইইডির স্বপ্ন হচ্ছে গণতান্ত্রিক, প্রতিবেশগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা।
নারী-পুরুষ সমতা, জীবনমানের নিরাপত্তা, সুশাসন ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন এগিয়ে নিতে জনউদ্যোগকে উদ্দীপ্ত করা আইইডির লক্ষ্য। আইইডি’র অভীষ্ট কর্ম সহযোগী হচ্ছে সব পর্যায়ের নাগরিক, বিশেষত তরুণ, নারী, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সংঘ, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। আইইডি নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবেশ এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে।
ময়মনসিংহে আইইডি ২০০৪ সাল থেকে কাজ শুরু করেছে। ময়মনসিংহ নগরীর বলাশপুর আবাসন, র্যালির মোড়, কালিবাড়ি, চরপাড়া, পুরহিতপাড়া, কৃষ্টপুর, বাঁশবাড়ি, আকুয়া, গোহাইলকান্দি মীরবাড়ি, খালপাড় এলাকায় কাজ করে। ৫০টি নারী দলে এক হাজার ১৬ জন নারী সদস্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। এ ছাড়াও ১০টি পুরুষ দল, ছয়টি কিশোরী দল, ছয়টি কমিউনিটি ফোরাম, একটি যুব ও সংস্কৃতিক ফোরাম, নারী ফোরাম এবং জনউদ্যোগ প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সব দল ও ফোরামের সঙ্গে জনউদ্যোগ প্ল্যাটফর্ম প্রশাসন পর্যায়ে অ্যাডভোকেসির পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগণের অধিকার আদায়ে কাজ করে।
বলাশপুরের স্বপন সেন বলেন, আমি বলাশপুর আবাসন কমিউনিটি ফোরামের সদস্য। এই ফোরামের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে উপলদ্ধি করেছি— কমিউনিটি ফোরাম কাজ করার বড় জায়গা। এর মাধ্যমে আমরা আপৎ-বিপদ ঠেকাতে পারি, যৌথভাবে কাজ করতে পারি। আমরা আয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। বিভিন্ন সেবা দেওয়া যায়। সবশেষে বলব, কমিউনিটি ফোরাম আমাদের বড় শক্তি।
বলাশপুর আবাসন কমিউনিটি ফোরাম সভাপতি আব্দুল মোতালেব বলেন, এই কমিউনিটি ফোরাম আমাদের অর্জন। আমরা আমাদের স্থানীয় সব সমস্যা সমাধানের পথে যেতে পারি, এলাকা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি। মাদক, বাল্যবিয়ে, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, নারীদের আয়ের সঙ্গে যুক্ত করা, তাদের মর্যাদা দেওয়া, তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া— এ সব বিষয়ে আমরা আমাদের কমিউনিটিতে কাজ করি। গত এক বছরে আমাদের এলাকায় কোনো বাল্যবিয়ে হতে পারেনি। এটিও কিন্তু ফোরামের একটি সুবিধা।
গোহাইলকান্দি খালপাড়ের উদ্যোক্তা বিউটি আক্তার আইইডির সঙ্গে যুক্ত ছয় বছর ধরে। সংস্থাটি থেকে প্রশিক্ষণ ও সমর্থন নিয়ে নিজেই দোকান দিয়েছেন। বিউটি বলেন, আমার দোকানে কাপড়, থ্রিপিস, নানা ধরনের কসমেটিক পাওয়া যায়। তবে গত এক বছরে আমি আইইডি থেকে চট দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ব্যাগ ও শাড়িতে পেইন্টের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নতুন করে এসব পণ্য তৈরি করে বিক্রি করছি। এতে ব্যবসা বড় হয়েছে, আয়ও বেড়েছে।
আকুয়া জুবলী কোয়াটার এলাকার রিয়া ‘অপরাজিতা কিশোরী’ দলের আহ্বায়ক। কিশোরীদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতায় কাজ করার পাশাপাশি ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানি বা অন্যান্য ঘটনা থেকে কিশোরীদের সুরক্ষিত রাখা নিয়ে কাজ করে সংগঠনটি।
কিশোরী রিয়ার ভাষ্য, ‘আইইডির কিশোরী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি বুঝতে পেরেছি নিজেদের কীভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো রাখতে পারি। নিজেকে ইতিবাচকভাবে বদলে নেওয়ার জায়গাগুলো বুঝতে পেরেছি। নিজেকে আত্মনির্ভর করতে পেরেছি। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়ে সব ধরনের ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানি থেকে নিজেরেই নিজেদের রক্ষা করতে শিখেছি। ভবিষ্যতে আমি নিজেকে একজন দক্ষ কারাতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখতে চাই। এই পথচলায় আইইডি সবসময় আমার পাশে থাকবে বলে আমি মনে করি।’
আইইডির কার্যক্রম প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জনউদ্যোগের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, আইইডি কোনো ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠান নয়। এটি কাউন্সেলিং, নেটওয়ার্কিং ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে সবাইকে সহায়তা করে থাকে। এর জনউদ্যোগ সংগঠনটি সমাজের মানুষের অধিকার, বিভিন্ন অনিয়ম প্রতিরোধ ও পরিবেশের সুরক্ষায় ভূমিকা রেখে চলছে। নগরীর জলাবদ্ধতা, যানজট, নদী দখল-দূষণ, নাব্য ফেরাতে খনন ও নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সংগঠনটি কাজ করেছে।
ময়মনসিংহ মহিলাবিষয়ক অধিদফতর উপপরিচালক নাজনীন সুলতানা বলেন, আইইডি নারীদের নিয়ে কাজ করে। নারীরা কীভাবে সেবা পেতে পারে, সেই লক্ষ্যে আইইডি নারীদের স্বাবলম্বী হতে কাজ করে যাচ্ছে। আর সরকারের পক্ষে একা কাজ করা সম্ভব নয়। সবাই মিলে কাজ করলে সেই কাজ সুন্দর ও পরিপাটি হয়। আইইডি সেই কাজ করে যাচ্ছে। সরকার থেকেও আমরা যতটুকু সম্ভব, সহায়তা করছি।
সারাবাংলা/টিআর
অ্যাডভোকেসি আইইডি নেটওয়ার্কিং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা