Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিপজ্জনক ‘কসমোপলিটন’ ডেঙ্গু দেশে, বাহক পর্যটক-রোহিঙ্গা

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২০ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:১৭ | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:৪৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ডেঙ্গুর সবচেয়ে বিপজ্জনক সেরোটাইপ ‘ডেন-২’-এর সাবগ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ‘কসমোপলিটন’ ধরনের ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে দেশে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ডেন-২ সেরোটাইপ ও কসমোপলিটন ধরনের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে পাওয়া গেছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

গবেষকরা বলছেন, ভারত ও মিয়ানমারে এর আগে এ বিপজ্জনক ধরনের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও বাংলাদেশে এই প্রথম। মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং ভারত-বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করা ব্যক্তিদের মাধ্যমে ডেঙ্গুর এ ধরনটি দেশে প্রবেশ করেছে বলে তাদের দাবি।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য খাত নিয়ে গবেষণাভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চলতি বছরের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে গবেষণা করছে আইসিডিডিআরবি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ।

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ গবেষণা দলে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার, ডা. আবুল ফয়সাল, মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডা. মো. আবদুর রব।

ডা. মো. আবদুর রব সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ আছে— ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। এর মধ্যে ডেন-২ সবচেয়ে ক্ষতিকর সেরোটাইপ। কসমোপলিটন ধরন হচ্ছে ডেন-২ সেরোটাইপের একটি সাবগ্রুপ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলতি বছরে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি, তাদের অনেকের মধ্যে কসমোপলিটন ধরনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরী মিলিয়ে দুই হাজার ৪২০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের।

চট্টগ্রামে হাসপাতালে ভর্তি অন্তত ২০০ রোগীর তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রান্ত ৮৮ শতাংশ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ডেন-২ সেরোটাইপ। তাদের মধ্যে অর্ধেকই অর্থাৎ ২০০ রোগীর মধ্যে ৪৪ শতাংশই কসমোপলিটন ধরনে আক্রান্ত। এ ছাড়া ১১ শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে ডেন-৩ সেরোটাইপে আক্রান্ত।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষকরা ২০২৩ সালে আক্রান্ত দেড় হাজার ডেঙ্গু রোগীর জিনোম সিকুয়েন্স করেন। তাতে দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ রোগী ডেন-২ সেরোটাইপে আক্রান্ত ছিলেন। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৬৫ শতাংশ। প্রতি পাঁচজন রোগীর একজন ছিল শিশু।

আবদুর রব বলেন, ‘ডেন-২-এর সাবগ্রুপ, যেটাকে ইউরোপ কসমোপলিটন ধরন নামকরণ করেছে, এটা খুবই মারাত্মক ও রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা অতিরিক্ত বমি, ডায়রিয়া, কিডনি ফেইলিওর, ফুসফুসে পানি জমে থাকাসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ উপসর্গে আক্রান্ত হন। এদের মৃত্যুহারও খুব বেশি।’

গত ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেলিনা আক্তার (৩৬) নামে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক নারী মারা যান। তার ছেলে মেহরাজ আলী সজীব জানিয়েছিলেন, সেলিনা প্রথমে মাথা ব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দুই দিনের মধ্যে তার পেট ফুলে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে বমি ও ডায়রিয়া শুরু হয়। এরপর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং পরে মারা যান।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুহারের যে ঊর্ধ্বগতি, তার পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে কসমোপলিটন ভ্যারিয়েন্ট।

ডা. আবদুর রব সারাবাংলাকে বলেন, ‘কসমোপলিটন ভ্যারিয়েন্ট ইউরোপে আগেই শনাক্ত হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত-মিয়ানমারেও গত বছর কিংবা তার আগে শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এবার প্রথম পেলাম। এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যেসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, তাতে কসমোপলিটন ভ্যারিয়েন্টের আধিক্য বেশি। এ জন্য বলছি, আগেও এ ভ্যারিয়েন্টে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন, তবে এত আধিক্য ছিল না।’

‘আমাদের ধারণা, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং ভারতে আসা-যাওয়া করেন এমন লোকজন কিংবা পর্যটকদের মাধ্যমে কসমোপলিটন ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে ছড়াতে পারে,’— বলেন ডা. রব।

এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন জানিয়েছেন, গত ৫ অক্টোবর জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভাণ্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) গবেষণাটি গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়া গবেষণা প্রতিবেদনটি ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনেও গৃহীত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের ৬০ শতাংশই চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচটি এলাকার বাসিন্দা। এ হিসাবে নগরীর বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও বায়েজিদ বোস্তামিকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

এর আগে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম নগরীর ছয়টি এলাকাকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ‘লাল’ তালিকাভুক্ত করে। এগুলো হচ্ছে— কোতোয়ালি, বাকলিয়া, বায়েজিদ বোস্তামি, বন্দর, পাহাড়তলী ও খুলশী।

সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের হিসেব বিবেচনা করে চট্টগ্রাম নগরীতে তিনটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল সিটি করপোরেশন। এলাকাগুলো হলো— কোতোয়ালি, বাকলিয়া ও বায়েজিদ বোস্তামি।

চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। মধ্য অক্টোবর পার করে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৫ জন, মার্চে ২৮ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মে মাসে ১৭ জন, জুনে ৪১ জন, জুলাইয়ে ১৯৮ জন ও আগস্টে ২০২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়।

এরপর এক সেপ্টেম্বর মাসেই ডেঙ্গু রোগী বেশি শনাক্ত হয় আগের আট মাসের মোট ডেঙ্গু রোগীর ৫০ শতাংশের বেশি। আগের আট মাসে যেখানে ৫৯৮ জনের ডেঙ্গ শনাক্ত হয়েছিল, সেখানে এক সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ৯০৭ জন।

অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ মাসের প্রথম ১৯ দিনেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯১৫ জন। অর্থাৎ এই ১৯ দিনেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সেপ্টেম্বর মাসের মোট রোগী ছাড়িয়ে গেছে।

এদিকে চলতি বছরে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। এর মধ্যে জানুয়ারিতে দুজন, মার্চে একজন, জুলাইয়ে একজন, আগস্টে একজন, সেপ্টেম্বরে ১১ জন ও অক্টোবরের ১৯ দিনে পাঁচজন মারা গেছেন।

২০২৩ সালেও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৭ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮২ জন।

এর আগে ২০২১ সালে চট্টগ্রামে ২৭১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মারা যায় পাঁচ জন। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরী মিলিয়ে পাঁচ হাজার ৪৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। ‍মৃত্যু হয়েছিল ৪১ জনের।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

কসমোপলিটন ভ্যারিয়েন্ট ডেঙ্গু ডেন-২ সেরোটাইপ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর