জুমের ঘ্রাণে মাতোয়ারা পাহাড়, চলছে নবান্নের প্রস্তুতিও
৯ অক্টোবর ২০২৪ ১১:৩৯
বান্দরবান: পাহাড়ের সবুজ বুক জুড়ে ধাপে ধাপে বৈচিত্র্যময় সব ফসল। বর্ষা পেরিয়ে শরতের শেষ ভাগে এসে সেই ফসলের ঘ্রাণে এখন মাতোয়ারা পাহাড়। মৌসুম জুড়ে পাহাড়িরা যে জুম চাষ করেছেন, সেই জুমের ফসল যে পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে তাই জুমের ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় কাটছে জুমিয়াদের। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে পরিবারের সব সদস্য মিলে কাটছেন জুমের ধান। ফসল ঘরে তোলার আনন্দে পাহাড়ি পল্লিগুলোতে চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতিও।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িরা প্রতি বছর পাহাড় আগুনে পুড়িয়ে জুম চাষ করেন। জুমিয়ারা পাহাড়ে ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, মারফা, টক পাতাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজিও উৎপাদন করেন। তবে একটি পাহাড়ে পর পর দুই মৌসুমে জুম চাষ করা যায় না বলে জুমিয়ারা প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে জুমের চাষ করে থাকেন।
বান্দরবানের দূর্গমঞ্চলে বসবাসরত মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, লুসাই, বম, চাকসহ ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেকের কাছেই এখনো জুমই জীবিকা ও জীবনধারণের একমাত্র পথ। তবে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ম্রো সম্প্রদায় আদিকাল থেকে এখনো পর্যন্ত কেবল জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের জীবিকা সংগ্রহ করে।
জুমিয়া পরিবারগুলো প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জঙ্গল কাটে। জঙ্গলগুলো রোদে শুকানোর পরে মার্চ-এপ্রিল জঙ্গল আগুনে পোড়ানো হয়। এপ্রিল মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার করে প্রস্তুতি নেওয়া হয় ধান বপনের। তখন কেবল অপেক্ষা বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি নামলেই ধানসহ বিভিন্ন মিশ্র ফসল বপন করা হয়। কয়েক মাস পরিচর্যার পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে শুরু হয় জুমের ধান কাটা ও অন্যান্য ফসল সংগ্রহ। জুমের ফসল ঘরে তোলার সময় পাহাড়ি পল্লিগুলোতে আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসব।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়ে পাহাড়ে জুম চাষে উৎপাদিত পাকা ধানসহ মিশ্র সবজি ঘরে তুলতে ব্যাস্ত সময় পার করছেন জুমিয়ারা।
পাহাড়ে প্রায় চার-পাঁচ একর জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল লাগিয়েছিলেন রুমা সড়কের দলিয়ান পাড়ার জুমচাষি সিম ম্রো। তিনি জানান, এ বছর জুমের আশানুরূপ ফসল হয়েছে। জুমের পাকা ধান কেটে ঘরে তোলা হচ্ছে।
চিম্বুক-পুড়াবাংলা এলাকার রিংইয়ং ম্রো বলেন, আগাম লাগানো জুম ক্ষেতের ধান পেকেছে। কিন্তু যারা একটু দেরিতে চাষ করেছিল, তাদের ক্ষেতের ধান এখনো পাকেনি। তবে জুমের খুবই ভালো ফলন হয়েছে এবার। ফসল ঘরে তোলার পাশাপাশি নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতিও চলছে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য বলছে, বান্দরবান জেলায় ২০২৩ সালে জুম আবাদ হয়েছিল আট হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৪৮৯ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন ফসল। এ বছর জুম চাষের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমিয়ে সাত হাজার ৪৬০ হেক্টর নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে আট হাজার ২৬৭ হেক্টর জমিতে। ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ মেট্রিক টন।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. হাসান আলি বলেন, চলতি বছর প্রায় আট হাজার তিন শ হেক্টর জায়গায় জুম চাষ করা হয়েছে। জুমে ধান ছাড়াও সাথীফসল হিসেবে মরিচ, বরবটি, মারফা, চিনার, মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টাসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। জুমে উৎপাদিত ফসল এ অঞ্চলের খাদ্য চাহিদার অনেকাংশই পূরণ করে। বান্দরবানের প্রতিটি উপজেলায় চলতি মৌসুমের জুমের ধান এরই মধ্যে কাটতে শুরু করেছেন জুমচাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে পাহাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে, জমির উর্বরতাও কমছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করা সম্ভব হবে।
জুম চাষিদের নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে জানিয়ে হাসান আলী বলেন, জুমের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি বিভাগ কৃষকদের স্থানীয় জাতের সঙ্গে হাইব্রিড জাতীয় ধানসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে।
সারাবাংলা/টিআর