২৫ বছরের সম্পর্ক শেষ মাত্র ২ মাসে!
৪ অক্টোবর ২০২৪ ২২:১৮ | আপডেট: ৪ অক্টোবর ২০২৪ ২২:৪৭
ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর দীর্ঘ ২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত-বিএনপির মধ্যে হঠাৎ বেড়েছে দূরত্ব। মাত্র দুই মাসের মধ্যে এই দূরত্ব এখন দূর থেকেও আঁচ করতে পারছে সাধারণ মানুষ। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য ও কথাবার্তায়ও তা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন আয়োজনে সময় দেওয়া নিয়ে আগস্টের মাঝামাঝি বিএনপি ও জামায়াতের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে এই দূরত্ব রেখা স্পষ্ট হয়।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যখন প্রতিপক্ষ ছিল, তখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে জোট ছিল। আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও টিকে থাকার প্রশ্নে ভোট ও আন্দোলনের জোট গঠনে দুই দলের কেউ-ই আপত্তি করেনি। কিন্তু, বর্তমানে মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ না থাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতে ভিন্ন সমীকরণে বিদ্যমান মত পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
যেভাবে শুরু
গত ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন না বলে ঘোষণা দেন। সেই বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতারা এ নিয়ে কথা বলেন। অনেকেই জামায়াত নেতার এই বক্তব্যের মধ্যে ‘তলে তলে সমঝোতার’ গন্ধ খুঁজে পান।
অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার পরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থাকলেও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বোঝাপড়ায় কোনো সংকট নেই।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জামায়াত অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই একটা দল। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিরোধের প্রশ্ন আসবে কেন?’
অবশ্য একদিন পর অপর এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির নিজের আগের বক্তব্য থেকে সরে এসে বলেন, ‘প্রতিশোধ না নেওয়ার মানে হুচ্ছে আমরা আইন হাতে তুলে নেব না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অপরাধ যিনি করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। শাস্তিও হতে হবে।’
এর আগে, ২৮ আগস্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে পৃথক এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগী দেশ আমাদের খুবই প্রয়োজন। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আপনারা বদলানোর চিন্তা করেন কেন?’
তার এ বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় বিএনপি। গত ৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে লন্ডন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে দেখছি কিছু রাজনৈতিক দল একটি প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে। সে কারণে তারা বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলছে। এ ব্যাপারে আমাদের নেতা-কর্মীদের সজাগ থাকাতে হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের এসব বক্তব্যের জবাব দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীও। একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘একটি দল ফ্যাসিবাদের পক্ষে কথা বলছে। তাদের মনোবাসনা কী, সেটা জনগণ বুঝতে পারছে। তারা সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনভিত্তি এবং সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি বা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই। তাই ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর অনিবার্যভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার কথা বিএনপির। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন দ্রুত একটা নির্বাচন। কিন্তু, দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি। এতে করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখন অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
ফেনী-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যার সময় দেওয়া মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওই বক্তব্যের সমালোচনা করে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখনও শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। রক্তের দাগ মোছেনি। বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না।’
এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই সময় তিনি বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’
এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমেক বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিভিন্ন সংশোধন ও সংস্কারে মিনিমাম একটা সময় লাগবে। সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে একটা যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছে জামায়াত।’
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি
সূত্রগুলো বলছে, জামায়াত-বিএনপি বিরোধের আরেকটি কারণ হচ্ছে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর প্রশাসন, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব জায়গা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেসব জায়গায় নিজস্ব লোকের পদায়ন। উভয়দল চেয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তাদের লোক থাকুক। এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে এ জটিলতা বিরাট আকার ধারণ করে।
বিএনপিপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে— এমন খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একটা দলের কেন্দ্রীয় নেতাকে ভিসি নিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনাও হয়। পরে তাকে নিয়োগ না দিয়ে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে উপাচার্য নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান জামায়াত সমর্থিত হওয়ায় ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ পাওয়ার পর শিবির বেষ্টিত থাকায় বিএনপি সমর্থিত অনেককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করতে দেখা যায়। পরে অবশ্য ১২ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করা হয়।
এ ছাড়া, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি তুললে বিএনপি সমর্থকদের অনেককেই এর কড়া সমালোচনা করেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যেসব ব্যক্তি বা দল স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে আলাদা জোট গঠনের উদ্যোগ
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী ও সমমনা দলগুলো নিয়ে একটি ‘বৃহত্তর জোট’ গঠনে জামায়াতের উদ্যোগ ভালো চোখে দেখছে না বিএনপি। সরকার পতনের মাত্র ১২ দিনের মাথায় গত ১৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান কওমি মাদরাসাভিত্তিক কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতদিন মতের ভিন্নতা থাকলেও এই প্রথম ইসলামী দলগুলো এক টেবিলে বসে। জানা গেছে, ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবে তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের এই ঐক্যের বিষয়টি দুই দলের মধ্যে টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ। আওয়ামী লীগ মাঠে থাকা অবস্থায় যারা বিএনপির ‘ভোট ব্যাংক’ ছিল, সেখানে হাত দিয়েছে জামায়াত ইসলামীর আমির। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য হলে বিএনপির ভোটের হিসাব পাল্টে যেতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুয়েকটা বিষয় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ভিন্নমত থাকলেও আমরা মনে করি তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব নেই।’
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতির মাঠে অনেক কথা হয়, অনেকে অনেক কথা বলে। এগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে রাজনীতি হয় না। আমরা আমাদের মতো করে রাজনীতি করছি।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম