Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সবুজ ‘বিপ্লব উদ্যান’ ফেরত চান চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩ অক্টোবর ২০২৪ ২১:০১ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৪৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাণিজ্যিক অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করে ইট-পাথরের জঞ্জাল মুক্ত করে চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহাসিক বিপ্লব উদ্যানকে সবুজায়নের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা বলেছেন, নগরীতে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষের বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল বিপ্লব উদ্যান। সংস্কারের নামে গত কয়েক বছরে সবুজ এই আঙ্গিনাকে ধ্বংস করে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংস করে বিপ্লব উদ্যানে এমন উন্নয়ন বন্ধ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে বিপ্লব উদ্যান নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বিশিষ্টজনেরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, সুশীল সমাজ, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন অংশ নেন।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে নগরীর প্রাণকেন্দ্র ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় বিপ্লব উদ্যান ও এর চারপাশের ফুটপাতসহ প্রায় এক একর জমি ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ঢাকার রি ফর্ম লিমিটেড এবং চট্টগ্রামের স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে এ জমি বরাদ্দ দেয় চসিক।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া এই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কোনোরকম ‘সৌন্দর্যহানি না করে’ ২৫টি স্টল, ২৫টি ডিজিটাল স্ক্রিন, যাত্রী ছাউনি, পাবলিক টয়লেট, ওয়াকওয়ে, আলোকায়ন, ম্যুরাল, বসার স্থান, গ্লাস টাওয়ার, ফোয়ারা, স্কাল্পচার নির্মাণ করবে। রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার ব্যয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই বহন করবে এবং সিটি করপোরেশনকে বছরে এক লাখ টাকা কর দেবে। পাশাপাশি ডিজিটাল স্ক্রিনগুলোর জন্য সরকার নির্ধারিত হারে কর দেবে।

বিজ্ঞাপন

এই চুক্তি ও বিপ্লব উদ্যানের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে তখনই প্রতিবাদ করেছিলেন নাগরিকরা। কিন্তু সিটি করপোরেশন তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।

২০২০ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে খোরশেদ আলম সুজন দায়িত্ব নেওয়ার পর চুক্তির শর্তভঙ্গের অভিযোগে বিপ্লব উদ্যানে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ ও দোকান চালু স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চুক্তির শর্ত ভেঙে ১৫০ বর্গফুটের বদলে ২০০ বর্গফুটের দোকান, এক তলার পরিবর্তে দ্বিতল অবকাঠামো এবং নকশা বর্হিভূতভাবে নির্মিত স্থায়ী বসার আসন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। তবে পরবর্তী সময় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সেগুলো ফের চালু হয়। সম্প্রতি আদালতে রায়ে অবৈধ ঘোষিত হওয়া মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও সবুজ উদ্যানটিকে ধ্বংস করে বাণিজ্যিক স্থাপনা বরাদ্দ দেওয়া অব্যাহত রেখেছিলেন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিপ্লব উদ্যানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি আবার জোরালো হয়। এ প্রেক্ষাপটে নাগরিকদের কথা শুনতে তাদের মতবিনিময়ে ডাকে চসিক।

সভায় স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের অন্যতম কাজ হলো নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত ও পরিবেশ ঠিক রেখে নগরকে বাসযোগ্য করা। তা না করে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছপালা কেটে কংক্রিটের নগরীর বানানো হচ্ছে। বিপ্লব উদ্যানের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ উদ্যানের বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে। নাগরিকদের স্বার্থে বিপ্লব উদ্যানকে আবারো নাগরিকদের উদ্যান হিসেবে ফিরিয়ে আনতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বসবাস। এই নগরীকে সবার বাস উপযোগী করতে হবে। বিপ্লব উদ্যান নিয়ে সবাইকে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া ‘চট্টগ্রামে কোন প্ল্যানিং ইনস্টিটিউশন নেই। ফলে নগরীতে অপরিকল্পিত উন্নয়নের জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছে।’

সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক জাহিদুল করিম কচি বলেন, ‘বিপ্লব উদ্যানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণার স্মৃতি রক্ষার ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকে করতে হবে।’

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সালাউদ্দিন মো. রেজা বলেন, ‘বিপ্লব উদ্যান একটি প্রাকৃতিক উন্মুক্ত স্থান। এই উদ্যান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। উদ্যানটি বর্তমানে আগের অবস্থানে নেই। এটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। এটি পূর্বের পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া দরকার। এই উদ্যানে আর কোনো স্থাপনা চাই না।’

স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘বিপ্লব উদ্যানে সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্প নেওয়া হলে আমরা অতিরিক্ত দোকান নির্মাণের বিষয়টি তৎকালীন মেয়রকে অবহিত করি। তিনি আমাদের আশ্বস্থ করেছিলেন, অতিরিক্ত দোকান নির্মাণ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নকশা বহির্ভূতভাকে দ্বিতীয় তলায়ও দোকান নির্মাণ করে। পরে আমরা এই প্রকল্পে জড়িত না হওয়ার জন্য স্থপতিদের নোটিশ দিই। উদ্যানটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন আমাদের করণীয় বিপ্লব উদ্যানের অতিরিক্ত স্থাপনা উচ্ছেদ করা। একইসঙ্গে গাছপালা লাগানো ও মানুষের বসার পরিবেশ তৈরি করা।’

বিপ্লব উদ্যানকে রক্ষার দাবি জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক আসমা আকতার বলেন, ‘একটি উদ্যানে দেশীয় আইন অনুযায়ী ৫ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালায় ২ শতাংশ কংক্রিট স্থাপনা থাকতে পারে। কিন্তু বিপ্লব উদ্যানে কংক্রিট স্থাপনার পরিমাণ ৫৫ শতাংশের বেশি। আগে এই উদ্যানে সকল বয়সী মানুষ এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারতো। কিন্তু সে পরিবেশ আর নেই। বিপ্লব উদ্যান এখন ব্যবসায়ী ও টোকাইদের দখলে চলে গেছে। অবিলম্বে উদ্যানটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে সবার উন্মুক্ত করে দিতে হবে।’

রাজনীতিক হাসান মারুফ রুমি বলেন, ‘উন্নয়নের প্রথম শর্ত হলো পরিবেশ ও প্রাণিকুলকে রক্ষা করা, সবুজায়ন বৃদ্ধি করা। কিন্তু বিপ্লব উদ্যানে অপরিকল্পিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ইট-পাথরের জঞ্জাল সৃষ্টি করা হয়েছে।’

বিপ্লব উদ্যানের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরাও বিপ্লব উদ্যানে সবুজায়ন চাই। ছাত্রজীবনে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বিপ্লব উদ্যানে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। মেহগুনি ও কৃষ্ণচূড়াসহ নানা গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল এই উদ্যান। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওখানে কোনো সুস্থ মানুষ যেতে পারতো না। রাতের অন্ধকারে সেখানে বসতো মাদকের আসর। বৃষ্টিতে পানিতে ডুবে থাকতো এই উদ্যান। সেখান থেকে আজকের জায়গায় এসেছে সৌন্দর্য বর্ধনে প্রকল্পের মাধ্যমে। তবে এখন নানা স্থাপনা নির্মাণ করে উদ্যানটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে যে ১০ শতাংশ স্থাপনা আছে, এর বাইরে কোনো স্থাপনা আমরা চাই না।’

চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিপ্লব উদ্যান নিয়ে অতীতে যা হয়েছে, তার দায় নিতে চাই না। আপনাদের দাবি ও পরামর্শগুলো চসিকের সাধারণ সভায় উত্থাপন করা হবে। আমার বিশ্বাস, সবুজায়নকে গুরুত্ব দিয়ে বিপ্লব উদ্যানকে জনসাধারণের পার্ক হিসেবে ফিরিয়ে আনতে পারব।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

চসিক টপ নিউজ বিপ্লব উদ্যান সবুজ উদ্যান

বিজ্ঞাপন

লন্ডনের পথে খালেদা জিয়া
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩৯

আরো

সম্পর্কিত খবর