শাবিপ্রবিতে শিক্ষার্থীদের কাছে ২ শিক্ষকের শপথ, সমালোচনার ঝড়
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৫৫ | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:১৯
সিলেট: সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) নতুন নিয়োগ পেয়ে যোগদান করা উপউপাচার্য মো. সাজেদুল করিম ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ইসমাইল হোসেনকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা অনলাইন-অফলাইনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। পরে সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এটি মূলত মতবিনিময় অনুষ্ঠান ছিল।
শাবিপ্রবি সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সাজেদুল করিম ও ইসমাইল হোসেন শাবিপ্রবিতে যথাক্রমে উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। বিকেল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলনকক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় এক পর্যায়ে সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তাদের দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, সম্মেলনকক্ষে দাঁড়িয়ে নতুন যোগ দেওয়া দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী পলাশ বখতিয়ার। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ ছলিম মো. আবদুল কাদির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব, আবু সালেহ মো. নাসিমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
শপথবাক্যে বলা হয়, ‘মহান সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া যে আমরা ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি লাভ করেছি। আজ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদে যোগদানের মুহূর্তে ২৪ জুলাইয়ের সব শহিদদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।’
শপথে আরও বলা হয়, ‘মহান জুলাই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ও আদর্শকে সমুন্নত রাখতে আমরা শপথ করছি যে বিপ্লবী সরকার কর্তৃক যে দিকনির্দেশনা আমরা পেয়েছি সেই নির্দেশনা ও জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সচেষ্ট থাকব। দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ও শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তোলার জন্য আপসহীনভাবে নিয়োজিত থাকব। আমাদের বিদ্যা, গবেষণা ও সৎ কাজের মাধ্যমে দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাবিপ্রবি দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে আলোর পথ দেখাতে যেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তা নিশ্চিত করব।’
এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকের শপথবাক্য পাঠ করাকে অনেকেই লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেছেন।
সজিব সাজ নামে এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সার্কাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোভিসি ও ট্রেজারার মহোদয়কে শপথবাক্য পাঠ করালেন আমাদের মহামান্য সমন্বয়করা। লা জবাব, আপনারা সেরররররা, আপনাদের দায়িত্ববোধ দেখে আমরা আবেগাপ্লুত।’ আরেক শিক্ষার্থী মো. ফরহাদ হোসেন লিখেছেন, ‘আজকের দিনের সবচেয়ে কটূ দৃশ্য শপথবাক্য পাঠ করানো।’
আবদু্ল্লাহ আল মাসুদ লিখেছেন, ‘সম্মানিত শাবিপ্রবি শাখার সমন্বয়ক মহোদয়গণ এই সময় শপথ বাক্য পাঠ করানোর কাজে অনেক ব্যস্ত। তারা সময় করে প্রথমে শিক্ষকদের ও পরে শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। পরবর্তীতে টং, অটোওয়ালা মামা, দারোয়ান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। ও আচ্ছা, ভুলে গিয়েছিলাম, নতুন ভিসি স্যারকেও শপথ নিতে হবে সম্মানিত মহোদয়দের কাছে।’
এ ঘটনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে জুনায়েদ আহমেদ নামের একজন লিখেছেন, ‘শপথ পাঠ কি ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত কোনো বাক্য ছিল যে এইটা নিয়া ছি ছি করা লাগবে? যাদের এইটা নিয়ে… আছে তারা বোমা ফরিদের সময় আর জুলাই বিপ্লবের সময় স্যারদের ভূমিকা নিয়ে কই ছিল?’
বৃহস্পতিবার রাতভর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মুখে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘এটি আনুষ্ঠানিক কোনো শপথ অনুষ্ঠান ছিল না। নতুন প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় ছিল। মতবিনিময়ে শহিদদের আত্মত্যাগ ও জুলাইয়ের স্পিরিটকে ধরে রাখতে স্যারদের কাছে কয়েকটি দাবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিষয় উঠে আসে। যে ভিডিওটি সামনে এসেছে, এটি জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞা ছিল।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের বাক্যগুলো ছিল— জুলাই বিপ্লবে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা, আহতদের সুস্থতা কামনা এবং জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ও আদর্শ ধারণ করে ক্যাম্পাসকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি মুক্ত রেখে শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শাবিপ্রবি যেন দেশ, জাতি ও বিশ্বাবাসীকে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করার প্রতিজ্ঞা ছিল। আমাদের এই উদ্দেশ্যকে আমরা আরও সুন্দর ও যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে না পারার কারণে মূলত এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছ। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরির জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি।’
এ ঘটনায় শপথ নেওয়া প্রোভিসি অধ্যাপক মো. সাজেদুল করিম বা কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ইসমাইল হোসেনের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা। তবে অধ্যাপক সাজেদুল করিম একটি প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন প্রথম আলোকে। তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টি পরিকল্পিত কোনো শপথবাক্য পাঠ না। শিক্ষার্থীদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো পরিবেশটি হয়ে পরে শোকাবহ। এ ছাড়া ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় ক্ষোভ, দেশের চলমান প্রেক্ষাপট, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চ প্রত্যাশা এবং নতুন প্রশাসন আসায় অতিমাত্রায় আবেগে আপ্লুত হওয়া ইত্যাদি পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ বাক্যগুলো সবার মুখে উচ্চারিত হয়েছে। ঘটনাটি যেভাবে সমালোচিত হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটি হয়নি।’
সারাবাংলা/টিআর