অপরিকল্পিত উন্নয়নে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে চট্টগ্রাম
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:২২ | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৪৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্দর নগরী চট্টগ্রাম অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে বাসযোগ্যতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে বলে মন্তব্য এসেছে এক সেমিনার থেকে।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নতুন স্বপ্ন ও নতুন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম ভাবনা শীর্ষক নাগরিক সংলাপ থেকে এ মন্তব্য করা হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া।
সব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য লোক বসানোর দাবি জানিয়ে সুভাষ চন্দ বড়ুয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ভর করছে সুষ্ঠু, টেকসই ও গতিশীল নগর উন্নয়নের ওপর। জলজট বন্দর নগরী চট্টগ্রাম অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে বাসযোগ্যতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে। যানজট নগরবাসীর জীবনের চলার পথের সঙ্গী। প্রতিদিন দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি, শব্দ, নদী ও খাল। হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়, পাহাড়, নদী ও বন। আমাদের চারদিকে অন্তহীন সমস্যা। এর মূল কারণ হলো- আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোয় উপযুক্ত জ্ঞানী প্রজ্ঞাবান লোকের অভাব।’
তিনি বলেন, ‘যারা আছে তারা সার্কাসের প্রাণীর মতো। তারা কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে না। চারদিকে কী ঘটছে তা বুঝতে পারে না। আর তারা সুদূরপ্রসারী জিনিস অনুধাবন করতে অক্ষম। আমাদের এতদিন যে উন্নয়ন হয়েছে তা অজ্ঞতা, অক্ষমতা আর জবাবদিহিহীন কর্তৃত্ববাদের যোগফল। তথাকথিত উন্নয়ন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আসবে না। জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছে ঋণের বোঝা। মনে হয় হাজার বছর ধরে এই ঋণের বোঝা বহন করে যেতে হবে। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতে চট্টগ্রামের সব সমস্যাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করতে হবে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য লোক বসাতে হবে। আগের মতো আমলা দিয়ে হবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অগাধ বিশ্বাস আছে জানিয়ে সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। গুম হয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে অন্তর্বর্তী সরকার দিনের আলোয় নিয়ে আসতে পারবে। সেজন্য উনাদের সময় দিতে হবে। জনগণকে ধৈর্য ধরতে হবে। প্রতিদিন তাদের হাতে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিলে হবে না। মনে রাখতে হবে স্বৈরাচারের পতন যদি না হতো তাহলে দীর্ঘ পাঁচ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হতো। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই বাসযোগ্য চট্টগ্রাম বিনির্মাণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৬ বছর চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেক অন্যায়, অনাচার, মিথ্যাচার আমাদের চিন্তায়-চেতনায় প্রচণ্ড ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছিল। বিবেকের তাড়নায় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। বিবেকের দংশনে ভুগেছি । কিন্তু প্রশ্ন ও প্রতিবাদ করতে সাহসী হতে পারিনি। কারণ, আমাদের চারপাশে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, যে পরিবেশে প্রতিবাদ ও প্রশ্ন করার সব সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। সে পরিবেশটা কী ছিল? সেটা গণতন্ত্রের খোলসে স্বৈরাচার।’
চট্টগ্রামকে টেকসই নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট আমাদের ছাত্র-জনতা এক মহাকাব্য সৃষ্টি করেছে। তারা সাহসী, তারা প্রতিবাদ করেছে, রাস্তায় বুকের রক্ত দিয়েছে, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। তাদের জানাই আমার শ্রদ্ধা। এখন স্বৈরাচার নেই। দেশ মুক্ত। আমাদের এতদিনের না বলা কথা নির্ভয়ে বলতে পারব। নতুন স্বপ্ন দেখতে পারব। নতুন বাস্তবতায় চট্টগ্রাম নিয়ে নিজস্ব ভাবনা বলার চেষ্টা করব। চট্টগ্রামকে টেকসই বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। চট্টগ্রাম অন্য দশটা নগরের মতো শুধুমাত্র নগর নয়। এটা বন্দর নগরী।’
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন করা গেলে সেটা মাইলফলক হবে জানিয়ে ’বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ‘আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব চট্টগ্রামেই। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বৃষ্টির পানিতে চট্টগ্রাম শহরের অনেক এলাকার মানুষ পানিবন্দী থাকত। আমার পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। নতুন নতুন মেয়র আসে। তারাও প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। ঢাকায় আমি দেখেছি প্রত্যেকটি ড্রেনের ওপর স্ল্যাব দেওয়া। চট্টগ্রামে সেটাও দেওয়া হয় না। মানুষ ড্রেনে পড়ে মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত নগরী যদি বলা হয় চট্টগ্রাম সেখানে এখনও পৌঁছাতে পারিনি। চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার আদৌ দরকার আছে কি না সেটা নিয়ে ভাবা দরকার ছিল। এখন তো এক্সপ্রেসওয়ে হলো। কিন্তু আদৌ কতটুকু যানজট আমরা নিরসন করতে পেরেছি। এখনও ফ্লাইওভারের নিচে আগের সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা যদি নিরসন করা যায় তাহলে সেটা হবে মাইলফলক।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমীর উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের মাতৃভূমি হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। দেশে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ২ হাজার কোটি খরচ হয়েছে। বাকি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে লোপাট হয়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা মেয়র পর্যন্ত যেত। মেয়র ছিল দুর্নীতিবাজ। তার আগের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ছিল দুর্বৃত্ত। চট্টগ্রাম ক্রীড়া সংস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মঞ্জুর কিবরিয়া বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মূল কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু যতগুলো মেয়র আসছে তারা এ বিষয়ে ভালো কোনো কাজ করেননি। সুইপারনির্ভর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরে আছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এখনও ম্যানুয়াল। এভাবে কোনো শহর চলে না। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই। বন্দরের সহায়তায় কর্ণফুলী নদীকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা সাজাতে হবে, দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে। কর্ণফুলী দখলদার আছে ২ জাহার ৪৯২ জন। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু বৃষ্টি হলেই মেয়েকে এক বুক পানিতে নেমে স্কুল থেকে আনতে হয়েছে। তাহলে এত টাকা কই যায়। এসবের হিসেব নেওয়া উচিত।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে সব আছে, কিন্তু প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। এ নগরীর বাসিন্দা হিসেবে আমিও চাই একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও যানজটমুক্ত শহর। এখানে সমন্বয়ের অভাব বারবার অনুভব করেছি। আমাদের কোনো মহাপরিকল্পনা নেই চট্টগ্রাম শহর নিয়ে। চট্টগ্রাম নগরী নিয়ে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। ফুটপাতগুলো মুক্ত করা প্রয়োজন। যাতে সবাই নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারে। এখানে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। খেলার মাঠ নেই। হাঁটার জায়গা নেই।’
সাংবাদিক শামসুদ্দিন ইলিয়াস বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক শিশু মারা গেছে। পত্রিকায় লিখতে পারিনি। কী পরিস্থিতে গিয়েছি সেটা আমরাই জানি। আমরা সাংবাদিকরা যে কলামই লিখি সেখানে জনগণের কথা থাকতে হবে। শত কোটি টাকা খরচ করে উন্নয়ন করা হয়, কিন্তু আদৌ সেখানে কতটুকু জনস্বার্থ আছে সেটা আমরা ভাবি না। আমরা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশে ৩০ লাখ জলবায়ু শরণার্থী আছে। কিন্তু সরকার থেকে জলবায়ু নিয়ে যে পলিসি নেওয়া হয় সেখানে জনগণের স্বার্থ থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু এ বন্দরের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। দিন দিন এ নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। পলিথিন, প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্য এ কর্ণফুলী নদীকে নষ্ট করছে। চট্টগ্রাম বন্দর চাইলে এগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। কর্ণফুলী নদী থাকলে বন্দর বেঁচে থাকবে। আর বন্দর বেঁচে থাকলে চট্টগ্রাম বাঁচবে।’
ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য সিকান্দার খানের সভাপতিত্বে ও সুপিক আনোয়ারের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ইমরান বিন ইউনুস, গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী, চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা লতিফুল হক কাজমী ও তরুণ অর্থনীতিবিদ জিয়া হাছান।
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম