Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রায় প্রতি বছরই ছাড়া হয় কাপ্তাই হ্রদের পানি

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৪ আগস্ট ২০২৪ ২২:৩৯

কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। সারাবাংলা ফাইল ছবি

রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানি রুলকার্ড অনুযায়ী বিপৎসীমার কাছাকাছি গেলেই ছেড়ে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হ্রদের পানি বাড়ার পর পানির চাপ কমাতে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি অনেকটা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল এলাকাকে বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে পানি ছাড়া হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

রুলকার্ড অনুযায়ী (সময়সূচিভিত্তিক পানি উঠা-নামার পরিমাপ) হ্রদে ১০৯ মিনস সি লেভেল (এমএসএল) পানি ধারণের সক্ষমতা থাকলেও ১০৭ এমএসএলের অধিক অর্থাৎ বিপৎসীমার কাছাকাছি গেলেই পানি ছাড়ে কাপ্তাই বাঁধ কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২৪ আগস্ট প্রথম দফায় কাপ্তাই হ্রদের পানি নিষ্কাশন ছাড়াও বিগত বছরগুলোতে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যে ২০১৭ ও ২০২৩ সালে দুই দফায় পানি ছেড়ে দেওয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। এছাড়া ২০১৯ সালে ছাড়া হয় একবার।

২০১৭ সালের ১৮ জুলাই প্রথম ধাপে কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি স্বয়ংস্ক্রিয় জলকপাট দিয়ে পানি নিঃসরণের পর দ্বিতীয় দফায় আবারও ১৮ আগস্ট পানি ছাড়া হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই ছাড়া হয় কাপ্তাই হ্রদের পানি। গত বছরের (২০২৩) ১৫ সেপ্টেম্বর ও ১৯ সেপ্টেম্বর দুই দফায় কাপ্তাই হ্রদের পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

বিপিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, সারাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদায় এবং কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে বছরজুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকতে হয় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে টারবাইনের মাধ্যমে বাহিরে ফেলা পানি মিলিত হয় কাপ্তাই হ্রদ থেকে কর্ণফুলী নদীর অংশে। সেই পানি কর্ণফুলী নদী বয়ে শেষ গন্তব্য বঙ্গোপসাগর। তবে সারাবছর পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন করা না গেলে সমুদ্রের পানি জোয়ারের মাধ্যমে চলে আসে কর্ণফুলীতে। এতে করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত মদুনাঘাট পানি নিষ্কাশনের কেন্দ্রের পানিতে লবণাক্ততার প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব পড়ে চট্টগ্রাম নগরে ওয়াসার সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থায়। যে কারণে সারা বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে পানি নিঃসরণ করতে হয় কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে। কাপ্তাই হ্রদের পানির ‘অর্থনৈতিক গুরুত্ব’ থাকায় বিপৎসীমায় না পৌঁছানো পর্যন্ত পানি ছাড়ে না কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানির সংকটে যা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। সারাবাংলা ফাইল ছবি

যদিও মৌসুমভিত্তিক কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়া-কমার ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন। বর্ষা মৌসুমে হ্রদে পানি বাড়ার ফলে সর্বোচ্চ কিংবা ২০০ মেগাওয়াটের অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে কখনো কখনো উৎপাদন নেমে আসে ২০ মেগাওয়াটে। দেশের একমাত্র এই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে সব ইউনিট চলমান রাখা সাপেক্ষে প্রতি ইউনিটের দাম পড়ে ৪০ পয়সারও কম। যা গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের চেয়ে জ্বালানি খরচের দিক থেকে অনেক সাশ্রয়ী।

চলতি বছর বন্যায় রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার কয়েকটি উপজেলায় বন্যা পিরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করেই বেড়েছে কাপ্তাই হ্রদের পানি। দৈনিক দুই-আড়াই এমএসএল পানি বেড়েছে হ্রদে। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে বিপৎসীমার কাছাকাছি পানি হওয়ায় পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রাত ১০টা থেকে কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি জলকপাট দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।

যদিও গেল কয়েকদিন ধরেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচ ইউনিট দিয়ে ২১৬-২১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। রাত থেকে ৯ হাজার কিউসেক পানি ছাড়ার কথা বলা হলেও এর চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ পানি নিষ্কাশন হয়ে আসছে। এই পানি কর্ণফুলী নদী অববাহিকতায় মিলছে বঙ্গোপসাগরে।

এদিকে, শনিবার দুপুর ৩টায় এক জরুরি বার্তায় কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে রাত ১০টায় পানি ছাড়া কথা জানায় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। জরুরি বার্তায় বলা হয়েছে, ‘দুপুর তিনটা পর্যন্ত হ্রদে পানি আছে ১০৭ দশমিক ৬৬ এমএসএল। যা বিপৎসীমার কাছাকাছি হওয়ায় লেকের উজান ও ভাটি এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে শনিবার রাত ১০টা থেকে ১৬টি গেইট ৬ ইঞ্চি করে উঠিয়ে দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হবে।’

কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরছেন জেলেরা, ছবি: সারাবাংলা

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) এটিএম আব্দুজ্জাহের সারাবাংলাকে জানান, আমরা যে পরিমাণ পানি ছাড়ার কথা বলেছি প্রতি সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক; সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলেই প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। যা ৯ হাজার কিউসেকের তিনগুণেরও বেশি। পানি ছাড়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে।’

প্রকৌশলী আব্দুজ্জাহের সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় প্রতিবছরই পানি ছাড়া হচ্ছে। গত বছরও দুইবার পানি ছাড়া হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতেও পানি ছাড়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কয়েকবছরে হ্রদে পানি কম থাকার কারণে পানি ছাড়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি।’ তিনি পানি ছাড়া নিয়ে স্থানীয় জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার আমলে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। বাঁধ দেওয়ার ফলে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির উপজেলা বিস্তৃত জনপদ ডুবে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের। সেসময় বিশাল এলাকার জনভূমি পানিতে ডুবে উদ্বাস্তু হন পাহাড়ের হাজার হাজার মানুষ। এরপর কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদে পানি সংরক্ষণে করে সেই পানি দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে দেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন। শুরুতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও বর্তমানে সরকারি হিসাবে ২৩০ মেগাওয়াট বলা হলেও ২৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কাপ্তাই হ্রদে বাঁধ দেয়া অংশে ১২.২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১.৩ মিটার প্রস্থের ১৬টি জলকপাট বা স্লুইসগেইট রয়েছে। এগুলো দিয়ে একসঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নির্গমন করতে পারে।

সারাবাংলা/এমও

কাপ্তাই হ্রদ টপ নিউজ রাঙ্গামাটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর