হালদার বাঁধ ভাঙল, সঙ্গে ইসমাইলের কপাল!
২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৭:০৩ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৮:৩৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: হালদা নদীর পাড়ের এক গ্রাম, ফটিকছড়ি উপজেলার সুয়াবিল ইউনিয়নের বারমাসিয়া। ওই গ্রামের দাইয়াপাড়ায় ছোট্ট এক মাটির ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস রিকশাচালক মো. ইসমাইলের। গেল কয়েকদিনের টানা অতিবর্ষণে হালদার বাঁধ ভাঙে। ভাঙল ইসমাইলের কপালও। সর্বনাশা পানির ঢলে প্রায় ভেঙেছে ঘর, ভাসিয়ে নিয়েছে তার সংসারের সব সম্বলও। ঘরের মাচায় উঠে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছেন, স্বান্ত্বনা কেবল এটুকুই!
ইসমাইলের মতো কপাল পুড়েছে হালদা পাড়ের কৃষক মো. সেলিমেরও। তার বাড়ি ফটিকছড়ির সুন্দরপুর ইউনিয়নের আজিমপুর গ্রামে। প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে আমনের চাষ করেছিলেন। চোখের সামনে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে হালদার বাঁধ ভেঙে আসা পানির ঢল। থৈ থৈ পানির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া সেলিমের আর কিছুই করার নেই!
পানির রুদ্ররূপ দেখা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, মীরসরাইসহ আরও বিভিন্ন উপজেলার লাখো মানুষের সবার কাহিনী এখন প্রায় এমনই। কেউ তিনদিন, কেউ চারদিন ধরে পানিবন্দি। মানুষ, প্রাণি– সবাই লড়ছে পানির সঙ্গে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। কেউ পাকা দালানের ছাদে উঠে, কেউ মাটির ঘরের মাচায়, কেউ বা ঘরের ভেতর খাট-আলমিরার ওপর বসে কোনোমতে সময়গুলো পার করছেন। কেউ আছেন পুরোপুরি অনাহারে, কেউ অর্ধাহারে। ত্রাণ পৌঁছানো এখনও সম্ভব হয়নি বিস্তীর্ণ গ্রামগুলোর সবখানে।
শনিবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে সারাবাংলার স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দী ফটিকছড়ি উপজেলার সুয়াবিল ও হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানিয়েছেন, অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক এখনও পানির নিচে। ঘরবাড়িতে পানিবন্দি হয়ে আটকে আছেন হাজার, হাজার মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রে যাবার মতো পরিস্থিতি নেই অনেকের। তাদের উদ্ধারের উদ্যোগও খুবই সীমিত। খাবার পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে।
হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের পাটিয়ালছড়ি গ্রামে দেখা মেলে মো. ইয়াছিন নামে এক ব্যক্তির। তিনি সারাবাংলাকে জানান, তিনদিন ধরে পানিবন্দি থাকার পর শনিবার দুপুরে সাঁতার কেটে তিনি গ্রামের অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা শহরটিলায় আসেন। ত্রাণের আশায় তিনি ঘর থেকে বের হয়েছেন।
বারমাসিয়া গ্রামের নাড়িরকূল এলাকার মো. সেলিমের বয়স প্রায় ৪৫ বছর। বুঝতে শেখার পর থেকে তিনি তাদের গ্রামে এত পানি আর কখনোই দেখেননি বলে জানালেন।
সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ডেকোরেশনের দোকানে কাজ করি। কষ্ট করে ভাত দুটো খাই। চার মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বন্যা সব নিয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবো জানি না। চারদিন ধরে পানির মধ্যে আটকে আছি। আমাদের গ্রামে এক ছটাক ত্রাণও পাইনি। খেয়ে, না খেয়ে সময় কাটাচ্ছি।’
একই গ্রামের দক্ষিণ হিন্দুপাড়ার বিমল দে, পেশায় ভ্যানচালক। তিনি জানালেন, ত্রাণ কিছু পেয়েছেন, কিন্তু রান্নার সুযোগ নেই। ঘর এখনও পানির নিচে, চুলা জ্বালানোর সুযোগ নেই।
বিমল দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিড়া, মুড়ি যা পেয়েছি সেটা খেয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছি। শুকনো খাবার কত আর খাওয়া যায়! রান্না করা যাচ্ছে না। ছোট ছেলেমেয়েগুলোর বেশি কষ্ট হচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারি না। চারদিন ধরে এভাবে চলছে।’
হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নে তৌহিদুল আনোয়ার হাইস্কুলের পাশে শফি আহমদ নামে এক ব্যক্তিকে দেখা যায়, যিনি কোমরসমান পানিতে ত্রাণের আশায় দাঁড়িয়ে আছেন। পাশের এক বাড়ির সামনে পারভিন আক্তার নামে এক গৃহবধূ বসে আছেন কলাগাছের তৈরি ভেলার ওপর, তা-ও এক মুঠো ত্রাণের আশায়।
শফি আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জন্মের পর এমন বন্যা আর দেখিনি। এত পানি আর দেখিনি। আল্লাহ, গুণাহ মাফ করে দাও।’
হালদা নদীর ভাঙনে শনিবার সকালেও চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। তবে শুক্রবার থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় পানি কমতেও শুরু করেছে। হাটহাজারীতে ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। তবে ফটিকছড়িতে এখনও লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
মীরসরাই উপজেলায় কাটাছড়ি, ইছাখালী, ধুম, হিংগুলি, ওসমানগঞ্জ, সাহেরখালী, খৈয়াছড়াসহ কয়েকটি ইউনিয়ন এখনও পানিবন্দি হয়ে আছে। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এসব ইউনিয়ন এবং মীরসরাই ও বারইয়ারহাট পৌরসভায় ১২ হাজার মানুষ শনিবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার রাত পর্যন্ত ফেনী নদীর পানি মীরসরাইয়ের শুভপুরে ৪১ সেন্টিমিটার এবং কালিয়াছড়িতে ৫১ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া ফেনী নদীর পানি ফটিকছড়ি উপজেলার রামগড় এলাকায় বিপৎসীমার ২০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
হালদা নদীর পানি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাট এলাকায় বিপৎসীমার ১১০ সেন্টিমিটার, পাঁচপুকুরিয়া এলাকায় ৩৭ সেন্টিমিটার এবং এনায়েতহাট এলাকায় ১৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের দশটি উপজেলার ৯৪টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে দুই লাখ ৬২ হাজার ৪০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ আছে। এছাড়া শুক্রবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা চট্টগ্রামে পাঁচজন।
চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা দলে দলে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন উপদ্রুত এলাকায়। শুকনো খাবার, মিনারেল ওয়াটারের পাশাপাশি রান্না করা খাবারও বিলি করা হচ্ছে। তবে মীরসরাই ও ফটিকছড়িতে বেশি উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ছবি: শ্যামল নন্দী, সারাবাংলা।
সারাবাংলা/আরডি/এমও