Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোনো দলের হয়ে আর কাজ করতে চান না পুলিশ সদস্যরা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৭ আগস্ট ২০২৪ ২২:০৫ | আপডেট: ৮ আগস্ট ২০২৪ ০৯:২২

বুধবার পুলিশ সদস্যরা চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠন ও ছাত্র আন্দোলনে হতাহত পুলিশ সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ ১১ দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের বেশির ভাগই বাহিনীটির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও কনস্টেবল পদের। বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করার কথাও বলেছেন।

বুধবার (৭ আগস্ট) বিকেলে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনে ‘অধস্তন পুলিশ সংস্কার প্ল্যাটফর্মে’র ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এসব পুলিশ সদস্য।

বিজ্ঞাপন

এ সময় নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আ স ম মাহতাব উদ্দিন, অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) আবদুল মান্নান মিয়া, অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ, উপকমিশনার (সদর) আব্দুল ওয়ারীশ, উপকমিশনার (ক্রাইম) নিষ্কৃতি চাকমা এবং উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) হুমায়ুন কবীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারাও পুলিশ সদস্যদের দাবিগুলোর সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন।

বিক্ষোভের সময় হ্যান্ডমাইকে এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আমাদের সহকর্মীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সাত মাসের গর্ভবতী এক নারী পুলিশ সদস্যও বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পাননি। অনেকেই নিখোঁজ। কোথায় আছে, আমরা জানি না। প্রত্যেক পুলিশ ভাইয়ের লাশ তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করতে হবে।’

‘আমাদের নিরাপত্তা আমরা নিজেরাই দিতে পারব। আমাদের নিরাপত্তার জন্য কোনো বাহিনীর প্রয়োজন নেই। আমাদের ভাইদের যখন মারা হচ্ছে, তখন কোনো বাহিনী আমাদের সহযোগিতা করেনি। আমরা কোনো সরকারের দালালি করব না। পুলিশকে আলাদা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দিতে হবে। বদলি-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের বদলি-বাণিজ্যের ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখা হয়েছে,’— বলেন ওই পুলিশ সদস্য।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দেখা যায়, দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য একত্রিত হয়ে নগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় খুন হওয়া পুলিশ সদস্যদের স্মরণ করে অনেককে কান্না করতেও দেখা গেছে। এরপর তারা বিক্ষোভ মিছিল করেন। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারী পুলিশ সদস্যরা পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে বসে পড়েন। পুলিশ সদস্যরা এ সময় ‘আমার ভাই মরলো কেন, জবাব চাই’, ‘এমপিদের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘বিসিএসের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’— এ ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন।

বিক্ষোভ থেকে পুলিশ সদস্যরা ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন। ছবি: সারাবাংলা

মনির হোসেন নামে এক পুলিশ সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অরাজনৈতিক একটি প্রতিষ্ঠান চাই। আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে থাকতে চাই না। আমরা কোনো এমপি-মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেবো না। আমাদের ভাই যারা মারা গেছে, সব লাশের হিসেব চাই আমরা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাইলে আমাদের ভাইদের রক্ষা করতে পারতেন। তারা চুপ ছিলেন।’

‘সাত মাসের গর্ভবতী আমার এক বোনকে খুন করা হয়েছে। পাহাড়তলী থানা থেকে নারী পুলিশ সদস্যদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা সবকিছুর জবাব চাই,’— বলেন মনির হোসেন।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আ স ম মাহতাব উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে যে দাবিগুলো উঠেছে, প্রতিটি দাবিই যৌক্তিক। যারা মারা গেছেন, তাদের শহিদের মর্যাদা দিতে হবে। তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। থানাগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। আলাদা পুলিশ কমিশন করার দাবি করা হয়েছে। এ দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের।’

‘কোনো দলের হয়ে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করতে চায় না। তারা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চায়। পুলিশ কোনো বিতর্কিত হতে চায় না। পুলিশ মরতে চায় বিজয়ের বেশে— দেশের জন্য, কোনো এমপি বা দলের জন্য না। আমাদের দাবি মানা হলে আমরা থানার কার্যক্রম শুরু করে দেবো,’— বলেন সিএমপির এই অতিরিক্ত কমিশনার।

পুলিশ নিরাপদ কি না— এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ কখনোই নিরাপদ বোধ করে না। পুলিশ মানুষের নিরাপত্তা দেয়। পুলিশ লাইনে আমরা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ছিলাম। এখনো নিরাপত্তাহীন আছি। আমাদের নিরাপত্তা আমরা নিজেরাই দিচ্ছি।’

নগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর) আব্দুল ওয়ারীশ বলেন, ‘পুলিশ লাইনসে যখন হামলা হয়েছে, আমরা কারও সহায়তা পাইনি। আমরা সরকারের অধীনে কাজ করি। আইন মেনেই আমরা কাজ করি। কোনো কোনো সময় আমাদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়। আমরা সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারি না। আমাদের সহকর্মীদের ক্ষোভগুলো আপনারা শুনেছেন। আমরা চাই আমাদের হাত-পাঁ যেন আর বেঁধে দেওয়া না হয়।’

‘আমরা আমাদের জন্য পৃথক পুলিশ কমিশন চেয়েছি। পুলিশ বিভাগ চেয়েছি। কিন্তু আমাদের সেগুলো দেওয়া হয়নি। আমাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এখন আমরা আশা করছি আমাদের সুযোগ দেওয়া হবে। আমাদের সহকর্মীদের যে দাবিগুলো সেগুলোর সঙ্গে আমরা কর্মকর্তারা একাত্মতা পোষণ করছি। এ দাবি আমরা আদায় করে ছাড়ব। দাবি পূরণ হলেই আমরা কর্মস্থলে ফিরে যাব,’— বলেন উপকমিশনার ওয়ারীশ।

এদিকে পুলিশ সদস্যরা যে ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— চলমান ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ হত্যাসহ সকল পুলিশি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অতি দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে; নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, আজীবন পেনশন-রেশনপ্রাপ্তি ও পরিবারের একজন সদস্যের সরকারি চাকরি নিশ্চিত করতে হবে; আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা ও গুরুতর আহত পুলিশ সদস্যদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে; পুলিশের নিয়োগ বিধিমালা, বিশেষত উপপরিদর্শক ও সার্জেন্ট নিয়োগ পিএসসির অধীনে ও পুলিশ সদর দফতরের অধীনে কনস্টেবল নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

দাবিতে আরও বলা হয়েছে— এসআই/ সার্জেন্ট পদে পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করতে হবে, সেক্ষেত্রে পুলিশ পরিদর্শক পদ থেকে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে ৩০ শতাংশ সরাসরি ও ৭০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ এবং সেটা যথাসময়ে নিশ্চিত করতে হবে; আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পুলিশের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আট ঘণ্টা করতে হবে এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য ওভারটাইমের ব্যবস্থা করতে হবে অথবা বছরে দুটি বেসিকের সমপরিমাণ অর্থ দিতে হবে; পুলিশের ঝুঁকিভাতা বাড়াতে হবে, টিএ/ডিএ বিল প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে দিতে হবে, প্রযোজ্য সব খাতে সোর্স মানি নিশ্চিত করতে হবে।

পুলিশ সদস্যরা বলেন, পুলিশ সদস্যদের বাৎসরিক ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি বাড়িয়ে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ৬০ দিন করতে হবে; পুলিশ বাহিনীর প্রচলিত পুলিশ আইন ও পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল সংস্কার করে যুগোপযোগী ও কার্যকর করতে হবে, যার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা ও অধ্বস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকার নিশ্চিত হয়; পুলিশ বাহিনীকে যেন কোনো দলীয় সরকার তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে; পুলিশের সব থানা, ফাড়ি ও ট্রাফিক বক্স আধুনিকায়ন করতে হবে এবং অধ্বস্তন অফিসারদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের অধ্বঃস্তন কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; এবং স্ব ব্যারাকে বিদ্যমান আবাসন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে ব্যারাকগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে।

সারাবাংলা/আইসি/টিআর

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ টপ নিউজ পুলিশের বিক্ষাভ সিএমপি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর