চন্দ্রবোড়ার অস্তিত্ব মেলেনি চট্টগ্রামে, তবু আতঙ্কে চলছে সাপ নিধন
২৩ জুন ২০২৪ ১১:২৭ | আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ১৪:১৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সম্প্রতি রাসেল’স ভাইপার নামে পরিচিতি পাওয়া চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে অব্যাহত প্রচারণায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামে। বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্কিত লোকজন সাপ নিধনে মেতেছেন। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একদিনে দক্ষিণ চট্টগ্রামে অন্তত চারটি সাপ পিটিয়ে মারার তথ্য পেয়েছেন তারা।
এ অবস্থায় বন বিভাগ সাপ নিধন না করার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করার কর্মসূচি নিয়েছে। সাপ গবেষকরাও অহেতুক সাপ না মারার অনুরোধ করে বলছেন, পরিবেশগত কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ মুহূর্তে চন্দ্রবোড়ার উপস্থিতি কিংবা বিস্তার লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সাপে কাটলে আতঙ্কিত না হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
চন্দ্রবোড়া সাপের কিছুটা বিচরণ ছিল মূলত পদ্মা নদীর অববাহিকার অঞ্চলগুলোতে। একসময় সাপটি দেশে প্রায় বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু একদশক আগে থেকে আবারও রাজশাহী অঞ্চলে এ জাতের সাপের সীমিত বিচরণ দেখা যায়। গত এক বছরে রাজশাহী অঞ্চল ছাড়াও মানিকগঞ্জ, ফরিদপুরের, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রামসহ ২৬ থেকে ২৭টি জেলায় এই সাপের উপদ্রব দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন- চন্দ্রবোড়া সাপ: সতর্ক থাকতে যা কিছু করণীয়
সম্প্রতি মানিকগঞ্জ, যশোর ও ঢাকার ধামরাইয়ে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে তিনজনের মৃত্যুর খবর মেলে। এরপর অন্তত একমাস ধরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে রাসেল’স ভাইপার নামে এ সাপের ব্যাপক বিচরণের তথ্য নিয়ে অব্যাহত প্রচারণা চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে আতঙ্ক ও অব্যাহত সাপ পিটিয়ে মারার ঘটনার মধ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য অনুরোধ জানানো হলো। তবে এ জাতের সাপটি চরিত্রগতভাবে আক্রমণাত্মক নয়। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে। মানুষের সঙ্গে এ জাতের সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সাপ সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপজঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে।
এদিকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ডেপুটি পাড়া এবং বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ঘোনারমোড় এলাকায় শুক্রবার (২১ জুন) রাতে দুটি সাপ পিটিয়ে মারা হয়। আনোয়ারা উপজেলা সদরে একটি বসতঘরে একটি সাপ মেরে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ মৌলভীকাটা এলাকায় একটি সাপ পিটিয়ে মারে আতঙ্কিত জনতা। পরে এসব সাপ মারার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আতঙ্কে নির্বিচারে সাপ নিধনের তথ্য পৌঁছেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লোহাগাড়ায় রাসেলস ভাইপার ভেবে যে দুটি সাপ মারা হয়েছে সেগুলো অজগর সাপ। একটি বার্মিজ পাইথন, আরেকটি গোলবাহার প্রজাতির অজগর। রামুতে মেরে ফেলা সাপটিও বার্মিজ পাইথন। আনোয়ারায় মেরে ফেলা সাপের ছবি স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, সেটি যেহেতু বসতঘরে পাওয়া গেছে, সেটি রাসেলস ভাইপার না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য অথবা পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী শনিবার (২২ জুন) সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বিচারে সাপ মারা হচ্ছে। গতকাল (শুক্রবার) এক রাতেই দুটি সাপ পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। অতি প্রচারণার কুফল আমরা ভোগ করছি। যেসব সাপ পিটিয়ে মারা হয়েছে সেগুলো বিষধর নয়, কোনোভাবেই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং আমাদের পরিবেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী। এমনকি রাসেল’স ভাইপারও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী একটি সংরক্ষিত প্রাণী। এই সাপ ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সাপের বিষ থেকে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়।’
‘রাসেল’স ভাইপার এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে দেখা যায়নি। চট্টগ্রামে রাসেল’স ভাইপারের কামড়ের শিকার হয়েছেন— এমন কেউ নেই। অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে কিছু অতি উৎসুক লোকজন সাপ পিটিয়ে মেরে ফেলছে। এর স্পষ্ট প্রভাব আমাদের পরিবেশের ওপর পড়বে। আমরা অহেতুক সাপ না মারার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা প্রচারণা শুরু করব কাল (রোববার) থেকে। রেঞ্জ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতার জন্য বলা হয়েছে,’— বলেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরী।
এদিকে শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম জুমে সারা দেশের সিভিল সার্জন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বিভাগীয় পরিচালক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকসহ দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন। এ সময় তিনি দেশের বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালকদের সঙ্গে সর্পদংশন ও চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে কথা বলেন এবং সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন। সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশের সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত রাখা এবং কোনো অবস্থাতেই অ্যান্টিভেনমের স্টক খালি না থাকার নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন- চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হোন: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এরপর বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী জেলার সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের জন্য এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছেন। এতে প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম মজুত এবং সাপে কাটা রোগীর জরুরি চিকিৎসার যাবতীয় প্রস্তুতি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্যানিটারি পরিদর্শক, স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য সহকারীদের স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াছ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। কোনো রোগীর চিকিৎসা নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে এর দায়ভার বহন করতে হবে। জনসাধারণকে বলব, অহেতুক আতঙ্কিত হবেন না। রাসেল’স ভাইপারসহ যেকোনো সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার হাসপাতালগুলোতেও আছে। ওঝা-কবিরাজের কাছে না গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে যান।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রাসেল’স ভাইপার কিংবা সাপ নিয়ে অহেতুক ভীতি দূর করতে লিফলেট, পোস্টার ও ব্যানার টানানোর নির্দেশনা দিয়েছেন সিভিল সার্জন।
সাপ গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী সারাবাংলাকে জানান, গত ২০ বছরে পদ্মা নদীপাড়ের ২৫-২৬টি জেলায় চন্দ্রবোড়া বা রাসেল’স ভাইপার সাপের সীমিত বিচরণ দেখা গেছে। তবে এসব জেলাতেও গণহারে নয়, দুয়েকটি এলাকায় বিশেষত কৃষিজমি ও ঝোঁপঝাড়ে এ জাতের সাপ দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত কারণে পদ্মা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কিছু জেলায় এ সাপের দ্রুত বিস্তার ঘটছে। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ সাপের এখনও কোনো অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি।
‘আদিকাল থেকে চন্দ্রবোড়া সাপ পদ্মা নদীর তীরের রাজশাহী ও আশপাশের আরও দুয়েকটি জেলায় ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি আরও কয়েক জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম-সিলেটের মতো পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে এ সাপের অস্তিত্ব নেই, ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এখানকার পরিবেশগত প্রভাব চন্দ্রবোড়া সাপের বসবাসের অনুকূল নয়। চট্টগ্রামেও রাসেল’স ভাইপার নিয়ে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, এটা একেবারেই ভ্রান্তিমূলক,’— বলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
চন্দ্রবোড়া বিস্তার লাভ করছে কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে এই গবেষক বলেন, ‘চন্দ্রবোড়ার মূল খাদ্য ইঁদুর। সেজন্য ফসলের ক্ষেতে এটার উপস্থিতি বেশি। কিন্তু চন্দ্রবোড়া শিকার করে যেসব প্রাণি— পেঁচা, বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ইগল, সারস, মদনটাক পাখি, শঙ্খিনী সাপ— এগুলো আমাদের প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। এর ফলে চন্দ্রবোড়ার বিস্তার সহজ হয়েছে।’
‘বলা হচ্ছে, রাসেল’স ভাইপার নিজ থেকে আক্রমণ করে কিংবা কামড় দিলে মৃত্যু নিশ্চিত— এগুলো একেবারেই অসত্য তথ্য। অন্যান্য সাপের মতো রাসেল’স ভাইপারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখলে তবেই আক্রমণ করে। আক্রমণের আগে হিস হিস শব্দ করে মানুষকে সতর্কও করে। বিশ্বে একমাত্র আফ্রিকান ব্ল্যাক মাম্বা আছে যেগুলো নিজ থেকে আক্রমণ করে। আর কোনো ভাইপারের বিষ এত শক্তিশালী নয় যে কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবে। এর অ্যান্টিভেনম বাংলাদেশে পর্যাপ্ত আছে,’— বলেন গবেষক আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
তিনি আরও বলেন, ‘চন্দ্রবোড়ার চেয়েও অন্তত ১০ গুণ বেশি বিষধর সাপ কেউটে-কোবরা আমাদের প্রকৃতিতে আছে। হঠাৎ রাসেল’স ভাইপার নিয়ে সংঘবদ্ধ আতঙ্ক কেন ছড়ানো হচ্ছে, এটা বুঝতে পারছি না। অহেতুক বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কারণে রাসেল’স ভাইপার কিংবা অন্যান্য যেসব সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য আরেকদফা হুমকির মুখে পড়বে।’
এদিকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্নেক রেসকিউ টিম, বাংলাদেশ’ চট্টগ্রামে অহেতুক সাপ পিটিয়ে না মারার অনুরোধ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রিতম সুর রায় জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে তাদের অন্তত ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী আছেন, যারা সাপ উদ্ধারে দক্ষ। কোথাও রাসেল’স ভাইপার বা অন্য কোনো সাপ দেখলে হত্যা না করে তাদের হটলাইন নম্বরে (০১৩০৩১২৯৯১৬) যোগাযোগের অনুরোধ করা হয়েছে। খবর পেলে স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা গিয়ে বিনামূল্যে সাপ উদ্ধার করে দেবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর