তারুণ্যের বাজেট ভাবনায় অগ্রাধিকার শিক্ষা, জীবনমানে
৬ জুন ২০২৪ ১৩:৫৫ | আপডেট: ৬ জুন ২০২৪ ১৬:০১
আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার প্রথম, সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের ২৫তম এবং দেশের ইতিহাসের ৫৪তম বাজেট হতে যাচ্ছে এটি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বড় আকারের এই বাজেটের প্রতিপাদ্য ‘সুখী সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’।
বাজেটকে সাধারণভাবে মনে করা হয় কাঠখোট্টা বিষয়, যার সঙ্গে তরুণদের সংযোগ কম। তবে আসন্ন জাতীয় বাজেট নিয়ে তরুণ সমাজের ভাবনা ও প্রত্যাশা জানার চেষ্টা করেছে সারাবাংলা ডটনেট। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে গতানুগতিক সেই ভাবনার প্রমাণ খুব একটা পাওয়া গেল না। বরং জানা গেল, তরুণরাও বাজেট নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। কোন খাতে কতটুকু বরাদ্দ থাকছে না থাকছে, সে বিষয়গুলো তারাও অনুসরণ করে থাকেন। গণমাধ্যমগুলোতে বাজেটের খবরগুলোও গুরুত্ব দিয়ে পড়েন বা দেখেন তারা।
এসব তরুণদের বাজেট ভাবনার বড় একটি অংশই শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার সর্বজনবিদিত গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তারা এই খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রত্যাশা করছেন বাজেট থেকে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাজেটে উদ্যোগ দেখতে চান তারা। বলছেন স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সরকার গুরুত্ব দেবে বলে প্রত্যাশা করছেন। চরমে পৌঁছানো মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা ও কর্মসংস্থান তৈরির প্রসঙ্গগুলোও উঠে এসেছে তারুণের বাজেট ভাবনায়।
আরও পড়ুন-
- বাজেটে যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে
- বাজেটে দাম বাড়তে পারে যেসব পণ্যের
- বৃহস্পতিবার বাজেট পেশ একটি রেওয়াজ
- বরাদ্দ বাড়ছে বিদ্যুৎ খাতে, কমছে জ্বালানিতে
- ৫৩ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে হাজার গুণ
- রাষ্ট্রপতি, অর্থমন্ত্রী ও উপদেষ্টাসহ ১২ জনের ৫৩ বাজেট
- ঋণের সুদ দিতেই সরকারের যাবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি
- স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সংকোচনশীল বাজেট, সামনে ৪ চ্যালেঞ্জ
- কাল বাজেট পেশ, আনারের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আসন শূন্য ঘোষণা
- স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আওয়ামী লীগের ২৫ বিএনপির ১৬ জাপার ৯ বাজেট
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম তিন মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে তরুণ জনশক্তির পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার।
এদিকে গত অর্থবছরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে প্রস্তুত করতে বাজেটে গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কাজে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব ছিল গত বাজেটে।
এসব তথ্য অনুসরণ করেন জানিয়ে নতুন বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সরকার বিবেচনায় রাখবে বলে প্রত্যাশা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার অহনা। তার প্রত্যাশা, জনগণের জীবনমানের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে আসন্ন বাজেট পাস হবে।
অহনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যায়, আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতি রেখে বাজেট পাস হয়ে আসছে। এর প্রভাব দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে আমরা দেখি মূল্যস্ফীতি চরমে পৌঁছেছে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বরাদ্দ আহামরি নয়। এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি মাথায় রেখে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমানো জরুরি। সরকার টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বিবেচনায় রেখে জনগণের জীবনমানের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট চূড়ান্ত করবে— এই প্রত্যাশা করছি।’
গতানুগতিক প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষা খাতে পরিকল্পনামাফিক গঠনমূলক বাজেট বরাদ্দের প্রত্যাশা রেখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দা রুতবা তাহসীন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বাজেট হয়। শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ হয়। অনেক কিছু শোনা যায়। কিন্তু খুব একটা কাজ করা যায় বলে মনে হয় না। আমাদের শিক্ষা খাতে প্রাথমিক থেকে শুরু করে একদম উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই পরিবর্তন দরকার। সেই পরিবর্তনের পরিকল্পনা ও কর্মপ্রক্রিয়া মাথায় রেখেই বাজেট যেন সাজানো হয়।’
মৌলিক চাহিদা পূরণের জায়গাগুলো চিন্তা করে যেন করের চাপ ও মুদ্রাস্ফীতি কমানোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মজিবুর রহমান তামিম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে গত কয়েক বছর থেকেই মানুষের জীবনমান কমছে। খাদ্যসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়ছে। সেদিক থেকে প্রত্যাশা, সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জায়গাগুলো চিন্তা করে যেন করের চাপ ও মুদ্রাস্ফীতি কমানোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার তুলনায় মৌলিক ও বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করা উচিত বলে মনে করেন এই তরুণ শিক্ষার্থী। বলেন, ‘দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত, বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে। যত্রতত্র অনার্স কোর্স, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালুর চেয়ে মৌলিক শিক্ষাকে আরও মানসম্মত ও বাস্তবমুখী করে তোলা জরুরি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা বিধোরা রওশন প্রভা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ভূমিকা থাকা চাই। এ জন্য দরকার কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। এসব বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্যে বড় একটা পদক্ষেপ হতে পারে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিলুপ্তি।’
তবে বাজেট যেমনই হোক, এর সঠিকভাবে বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার কথা বললেন প্রভা। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। প্রতি বছর বাজেট পাস হয়। বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু যেভাবে কাজ দেখি, তাতে সন্দেহ হয় বাজেট কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকৃত অর্থেই কতটুক কাজ হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যেকোনো খাতেই যা বাজেট হবে তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত হওয়াও জরুরি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রণয় দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের বাজেট প্রায় আট লাখ কোটির টাকার অঙ্কে পৌঁছাবে। এই বাজেটে দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচক থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন অবকাঠামোগুলো গুরুত্ব পেয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারছি। সে তুলনায় দেশের সামগ্রিক উন্নতির মূল উপাদান শিক্ষা প্রাধান্য পায়নি বললেই চলে।
প্রণয় বলেন, ‘আমাদের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ শতাংশের আশপাশে থাকে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। অর্থাৎ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বদলে কমানো হয়েছে। এগুলো আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমার মনে হয়, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত। যেকোনো একটি দেশের মেধাশক্তির উন্নয়নের শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেবল নয়, একমাত্র পথ। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর কোনো বিকপ্ল নেই।’
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন রিদম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত জনগণের জীবনমান। সেটি ঠিক করার জন্য যা কিছু করা দরকার, সেটুকু বাজেটে নিশ্চিত করতে হবে। আমার মৌলিক চাহিদা পূরণে যদি বাজেট ব্যর্থ হয়, সে বাজেট যতই বিশ্লেষণ করে ভালো বলা হোক, তাতে কোনো কাজ হবে না। আগে মৌলিক চাহিদা, মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কতটুকু কার্যকর হবে বাজেট— সেই প্রশ্নের মোকাবিলা হওয়া চাই।’
রিদম আরও বলেন, ‘শিক্ষার মান বাড়ানোর পাশাপাশি সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার সমান সুযোগ ও সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে, কেউ যেন বেশি কষ্টে না পড়ে। একটি অংশকে বাদ রেখে অন্য অংশকে সুবিধা দিয়ে শিক্ষায় কখনো উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে না।’
সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর
২০২৪-২৫ অর্থবছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট টপ নিউজ তরুণদের বাজেট ভাবনা বাজেট বাজেট ২০২৪-২৫