শ্রম আইন সংশোধন শুধু নয়, কার্যকর বাস্তবায়ন চান শ্রমিকরা
১ মে ২০২৪ ২৩:১৭ | আপডেট: ১ মে ২০২৪ ২৩:৫৮
ঢাকা: শ্রম আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আইনমন্ত্রী বলছেন, অল্প সময়ের মধ্যে শ্রম আইনের কয়েকটি বিষয়ে সংশোধনী আনা হবে। তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রম আইন সংশোধনে যেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরামর্শ অনুসরণ করা হয়। পাশাপাশি দাবি তুলেছেন এসব আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের। তাদের ভাষ্য, শুধু আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা করা যাবে না। কারণ আইনে অনেক কিছু বলা থাকলেও বাস্তবে এসবের কার্যকর প্রয়োগ নেই।
সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) আইএলও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এরপরই শ্রম আইন সংশোধনের কথা জানান তিনি। বলেন, কোনো কারখানায় ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান রেখে শ্রম আইন অল্প সময়ের মধ্যে সংশোধন করা হবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, শ্রম আইন সংশোধন বিল পাস না হওয়া পর্যন্ত অংশীজনদের কিংবা যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা শ্রমিক অধিকারের কথা বলে, তাদের কথা শোনা হবে। আমরা দেখব, আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুযায়ী যে শ্রমিক অধিকার রক্ষা করা হয়, তার সঙ্গে অংশীজনদের পরামর্শের কোনো পার্থক্য আছে কি না।
গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয়ে সংশোধনী শ্রম আইনে
শ্রম আইনের যেসব বিষয় সংশোধন হচ্ছে, তার মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকদের সম্মতির হার কমিয়ে আনতে আইএলওর পরামর্শ ছিল বলে জানান আইনমন্ত্রী। বলেন, আইএলওর একটি পরামর্শ ছিল থ্রেশহোল্ড (ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকদের সম্মতির হার) নিয়ে। যেসব কারখানায় তিন হাজার বা তার চেয়ে বেশি শ্রমিক আছে, সেসব কারখানায় এটা (শ্রমিকদের সম্মতির হার) ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলাম। আইএলওর পরামর্শ মেনে এখন সব কারখানার জন্য এই ১৫ শতাংশ থ্রেশহোল্ড রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যেকোনো কারখানায় ১৫ শতাংশ শ্রমিক রাজি হলেই একটি ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারবে। সংশোধিত শ্রম আইনে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, আমি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকদের সম্মতির হার ১৫ শতাংশ হবে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য একে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। সেটা ধীরে ধীরে সম্পন্ন হবে।
মালিকপক্ষের সাজা বাড়ানোর দাবি রয়েছে শ্রমিকদের। এ সংক্রান্ত ধারাও সংশোধন হচ্ছে শ্রম আইনে। আইনমন্ত্রী বলেন, শ্রমিক অধিকার যারা লঙ্ঘন করে তাদেরই সাজা বাড়ানোর ব্যপারে আইনে একটা ধারা আছে। এখানে পাঁচ হাজার টাকা সাজা ছিল। সাজা বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সেটা হয়তো ২৫ হাজার টাকাও করা হবে।
শ্রমিক-মালিকসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেই শ্রম আইনের ধারাগুলো সংশোধন করা হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী। বলেন, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও সুরক্ষার জন্য যার যার কথা শোনা প্রয়োজন, আমরা শুনব। ১২ মে আইনটি সম্পূর্ণ করার জন্য একটি সভা আয়োজন করা হবে।
শ্রম আইন সংশোধন প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতাদের দাবি অবশ্য একটু ভিন্ন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সহসভাপতি জলি তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে শ্রম আইনের ২৬ ধারার অপব্যবহার হচ্ছে। এ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করা হচ্ছে।’
‘আমরা চাই, কারখানা থেকে কখনোই কোনো শ্রমিককে যেন বের করে দেওয়া না হয়। আইএলওর পরামর্শ অনুযায়ী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। বিশেষ করে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও যেন শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে,’— বলেন জলি তালুকদার।
এই শ্রমিক অধিকার কর্মী আরও বলেন, নারী শ্রমিকদের জন্য ছয় মাসের সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের শাস্তি কমিয়ে আনতে হবে, মালিকদের শাস্তি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চাকরি শেষে শ্রমিকদের সার্ভিস বেনিফিট যেন পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে ৪৪টি খাতে শ্রমিকেরা কাজ করেন। তবে দেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন কয়েকটি ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি ধারা দেশি-বিদেশি এনজিও ধারা নিয়ন্ত্রিত। একটি ধারা শ্রম আইনের বিভিন্ন ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বড় করে তুলে ধরে নিজেদের সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। অন্য আরেকটি ধারা শ্রমিক ও মালিক উভয়ের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যৌথ দরকষাকষি করে শ্রমিক-মালিক সবার স্বার্থ রক্ষা করে। কারণ শ্রমিক ভালো না থাকলে মালিক ভালো থাকবে না। আর মালিকের প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে শ্রমিকও ভালো থাকবে না।’
সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা চাই সংবিধান অনুযায়ী শ্রমিক স্বার্থবিরোধী সব ধরনের আইন যেন পরিহার করা হয়। আবার কোনো আইন দ্বারা যেন শ্রমিক হয়রানি কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, কারখানাও যেন বন্ধ না থাকে। এসব বিষয়ে সরকার ও শ্রমিক-মালিক সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
৪৫ ধারা নিয়ে বিভ্রান্তি
এর আগে গত ২ নভেম্বর বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল ২০২৩ সংসদে পাস হয়। বিলে সম্মতির জন্য গত ৮ নভেম্বর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়। এরপর বিলটিতে সই না করে গত ২০ নভেম্বর তা সংসদে ফেরত পাঠান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে গত ২২ নভেম্বর সংসদ সচিবালয় এ সংক্রান্ত বার্তাসহ একটি বুলেটিন প্রকাশ করে।
ওই বুলেটিনে রাষ্ট্রপতির বার্তা তুলে ধরা হয়। বার্তায় বলা হয়েছে, এই বিলের দফা-৪৫ বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। দফাটি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানো হলো।
ওই বিলের ৪৫ নম্বর যে ধারার কথা রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেছেন সেটি বেআইনি ধর্মঘট বা লকআউটের দণ্ডসংক্রান্ত। এটি মূল আইনের ২৯৪ নম্বর ধারা। এই ধারার ১ উপধারায় শ্রমিকদের বেআইনি ধর্মঘটের দণ্ডের কথা বলা আছে। ২ উপধারায় মালিকপক্ষের বেআইনি লকআউটের দণ্ডের বিধান আছে। উভয় ক্ষেত্রে দণ্ড একই।
যেভাবে বিলটি সংসদে পাস হয়েছিল তাতে শুধু শ্রমিকদের বেআইনি ধর্মঘটের জরিমানা ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছিল। উপধারা ২ সংশোধন না হওয়ায় মালিকপক্ষের দণ্ড আগের মতোই ছিল। এতে বিভ্রান্তির আশঙ্কা থেকেই বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানো হয়।
এরপর শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শ্রম আইনের আরও কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবি ওঠে। সরকারও শ্রম আইন সংশোধনের আগে শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এসব বিষয় আলোচনা করার আশ্বাস দিয়েছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/টিআর
আইনমন্ত্রী কারখানা টপ নিউজ শ্রম আইন শ্রম আইন সংশোধন শ্রমিক অধিকার শ্রমিক আন্দোলন