মাঝের চরে বেড়িবাধ সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২১:০৪ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪ ০০:৩৭
ঢাকা: পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়নের ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। নাম তার মাঝের চর। স্থানীয়দের ধারণা, সুন্দরবন ঘেঁষা বলেশ্বর নদের মধ্যবর্তী স্থানে চর সৃষ্টি হয়েছে বলেই মানুষের মুখে মুখে মাঝের চর নামে খ্যাতি পেয়েছে। তবে দুঃখ-কষ্টে দিন যাচ্ছে মাঝের চরবাসীর।
নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান তারা। এ সব মানুষের সমস্যার শেষ নেই। চরের এক হাজার লোক নিরাপত্তাহীনতায়। প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে নেই পর্যাপ্ত বেড়িবাধ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বসতি শুরু হওয়ার পর ছোট ছোট কিছু রাস্তা নির্মাণ করা হয়। তাও নদীগর্ভে অনেকটা চলে গেছে, বাকিগুলো যাওয়ার পথে।
দুঃখ আর কষ্টের আর শেষ নেই তাদের। দেশের নাগরিক হয়েও পাচ্ছে না তারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। চরের চারপাশ ও নদীতে মৎস্য শিকার করে তাদের জীবন চলে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় ভোটের জন্য ছুটে যান দ্বীপটিতে। ভোটের পর তারা থাকেন দূরে।
দ্বীপটি এতই সুন্দর যে দ্বীপের চার দিকে জলরাশির নৃত্য দেখে চোখ জুড়াবে সবার। প্রতিদিনই ছুটছে মানুষ মাঝের চর দেখতে। দ্বীপটি পর্যটনকেন্দ্র হলে সরকারের রাজস্ব খাতে আয় বাড়ত।
৪০ এর দশকে জেগে ওঠা এ চরের জমির পরিমাণ প্রায় ৮৪০ একর। এক সময় এখানে বড় বড় কেওড়া ও ছৈলা গাছে ভরপুর আর নানা জাতের পাখি, পাতিশৃগাল, সাপ, শুকর এর দেখা মিলত। স্থানীয়রা গরু-মহিষ ছেড়ে দিতেন বছরান্তে। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সরকারি সহায়তায় ভূমিহীন মানুষ বসতি শুরু করলে আস্তে আস্তে অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে।
সরকারি বনায়নের পাশাপাশি রয়েছে সাড়ে ছয় হাজার নারিকেল গাছ। রক্ষণাবেক্ষণে আছে বনবিভাগের অফিস। পিরোজপুর, বাগেরহাট, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর ভ্রমণ পিপাসুদের অতি চেনা দ্বীপ বলেশ্বর নদের মাঝের চর, যেখানে সারাবছর দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান।
প্রায় ৮৪ বছরের পুরনো এই দ্বীপটির জনগণ প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে মজবুত বেড়িবাধ নির্মাণ হয়নি। সকাল-সন্ধ্যার আলো খেলা আর নোনাজলের জলকেলী, রুপালি ইলিশ শিকারের দৃশ্য বনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। অনতিদূরে দেখা মেলে বিশ্বের সর্বোচ্চ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অল্প অসম্পূর্ণ বেড়িবাধ চরের জীবন বিষিয়ে তুলেছে। চরের কিনারে ভাঙন দেখা দিয়েছে, যে কারণে জলের জমি ও বনের আয়তন কমে যাচ্ছে। বনের চারপাশে মজবুত বেড়িবাধ নির্মাণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বেড়িবাধটি দ্রুত নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।
দ্বীপটিতে বসতি গড়েছেন যারা পেশায় জেলে। মাছ শিকারের পাশাপাশি সামান্য কৃষি কাজও করেন। নদীজলের ভয়ংকর খেলা তুচ্ছ করে জীবনবাজি রেখে জীবনযুদ্ধে জীবিকার তাগিদে নদীর জীবন বেছে নিয়েছেন। নদীই যেন তাদের প্রাণ। সারাদিনের পরিশ্রমের ফসল নগণ্য পরিমাণের যে মাছ শিকার করে তা বিক্রি করার হাট-বাজার না থাকায় প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রায় ৩০০ ভূমিহীন পরিবারের বসতি মাঝের চরের বাসিন্দাদের আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা যেন নিত্যসঙ্গী। এক সময় ওখানে জলদুস্যরা আশ্রয় নিত। এখন জলদস্যুরা সেখানে যায় না। তারপরও জলদস্যুর আতঙ্ক রয়েছে। রয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সিডর, আইলা, কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন এর ভয়। বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তা বঞ্চিত জেলেপল্লীর বাসিন্দারা ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকার চায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে— ওখানে নেই কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেন এ চরের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা প্লাবনে নিরাপত্তার ঠাঁই ছোট দুটো সাইক্লোন সেন্টার।
আধুনিক জগতের মধ্যে আদিম যুগ এ যেন এক ভিন্ন জগৎ এই দ্বীপটি। রীতিমত জেলেপল্লীর কদাচিৎ ২/১ জনের স্বাক্ষর থকলেও অধিকাংশ স্বাক্ষরজ্ঞানহীন। জেলেদের সন্তান ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কোনোরকম চলার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ না থাকায় তাদের পড়ালেখা আর এগোয় না। দুই একজন দ্বীপ থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় নদী পার হয়ে কখনও কিংবা ব্যাটারি চালিত রিকশায় চড়ে এস এসএসসি পাস করেছে। এখন তাদের মধ্যে কেউ পুলিশে চাকরি করছে। দ্বীপটির জেলে পরিবারের ইচ্ছা তাদের সন্তানরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। এ জন্য তারা চায় বেশি সুযোগ-সুবিধা।
জেলেপল্লীবাসীর রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব। আধুনিক যুগজীবন সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার কেউ নেই। তাদের বিশ্বাস জেলেজীবন পাল্টানোর কোনো সুযোগ এ জীবনে সম্ভব নয়। ঋণের ভারে জর্জরিত জেলের ছেলে জেলেই থেকে যাচ্ছে। নিজদেশে যেন পরাধীন হয়ে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত তারা।
চরের বাসিন্দা সুলতান চৌকিদার (৮০) জানান, সরকার ১৯৬৬ -১৯৯০ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রতি ভূমিহীন জেলেকে দেড় থেকে তিন একর জমি ৯৯ বছরের জন্য মোট ২৮৮ একর জমি বন্দোবস্ত দেয়। ১৯৭৬ সালে ৫৪৩ একর জমি বনবিভাগকে হস্তান্তর করে।
মাঝেরচর জেলেপল্লীর বাসিন্দা মো. হাসান (৩০) বলেন, ‘দুঃখ-কষ্টে দিন যাচ্ছে। নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে না। এক হাজার লোক নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আমাদের দুঃখ-কষ্ট দেখার কেউ নেই।’
চরের বাসিন্দা জেলে মো. হানিফ ফকির (৬২) আক্ষেপ করে জানান, তার স্ত্রী হাসিনা বেগম (৫৬) গভীর রাতে ব্রেন স্ট্রোক করলে তাৎক্ষণিক কোনো চিকিৎসা দিতে পারেননি। চরের জেলেগোষ্ঠীর জীবন বাঁচাতে তিনি বেড়িবাধ নির্মাণের দাবি করেন।
মাঝেরচর মসজিদের ইমাম মো. আজাদুল ইসলাম (৩০) বলেন, ‘চরের অধিকাংশ মানুষ জেলে। যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। যে কোনো সময় প্লাবনে মসজিদ তলিয়ে যায় নামাজ আদায় করা যায় না।’
তিনিও চরের চারদিকে বেড়িবাধ তৈরির দাবি জানান।
পিরোজপুর মঠবাড়ীয়া-৩ আসনের সংসসদ সদস্য শামিম নেওয়াজ বলেন, ‘মাঝের চরে বসবাসকারীরা ঝুঁকি নিয়ে জীবনযাপন করছে। বিষয়টি আমার জানা আছে। তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বেড়িবাধ আছে। তবে সেটি সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব।’
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ‘পিরোজপুর জেলার মাঝের চরে চারিদিকে বেড়িবাধ নির্মাণের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
বরিশাল বিভাগের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান বলেন, ‘বেশির ভাগ বেড়িবাধেরই সংস্কারের প্রয়োজন। বিষয়টির জন্য রক্ষণাবেক্ষণ বাজেটের প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘মাঝের চরের বেড়িবাধের বিষয়টি পিরোজপুর নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
পিরোজপুর জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার নুসাইর হোসেনের সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কল সংযোগ কেটে দেন।
বেতমোর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়র হোসেন বলেন, ‘মাঝের চরের সমস্যার তো অন্ত নেই। বেড়িবাধের জন্য পিরোজপুর নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য সেবার জন্য সপ্তাহে দুদিন ডাক্তার মাঝের চরে যাওয়া আসা করে। স্থায়ীভাবে মাঝের চরে একটি ছোট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন ও যে কোনো সময় রোগীদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মাঝের চরে নাগরিক সুবিধা দেওয়ার জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আশা করি, আমাদের প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে।’
সারাবাংলা/একে