সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন: গণনা-ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা
৮ মার্চ ২০২৪ ১৬:১৪ | আপডেট: ৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:০১
ঢাকা: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনব্যাপী নির্বাচনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের পর গণনা এবং ফল ঘোষণা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দুই দিনব্যাপী ( ৬ ও ৭ মার্চ) নির্বাচনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হলেও গণনা এবং ফল প্রকাশ নিয়ে আইনজীবীদের দুই পক্ষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এক পর্যায়ে ভোট গণনা না করেই একজন প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান আবুল খায়ের।
এরপর ব্যালট পেপারের পাঁচটি ট্রাঙ্ক আইনজীবী সমিতির শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনের স্টোররুমে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে।
এরপর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য, প্রার্থী এবং আইনজীবীরা শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তন ত্যাগ করতে দেখা যায়।
তবে এ বিষয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, রাত ১০টার পর ভোটের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর রাত ৩টার দিকে ভোট বাছাই সম্পন্ন হয়। বাছাই শেষ হওয়ার পর ভোট গণনার উদ্যোগ নেওয়া নেয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি।
এমন সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেলের সমর্থিত সম্পাদক প্রার্থী শাহ মনজুরুল হক শুক্রবার দিনের আলোতে ভোট গণনার দাবি করেন। তখন স্বতন্ত্র সম্পাদক প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথী ও বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলের প্রার্থীরা রাতেই ভোট গণনার দাবি জানান। তারা নির্বাচন পরিচালনা কমিটিকে ভোট গণনা করে ফল ঘোষণা দাবি করতে থাকেন।
এ নিয়েই এক পর্যায়ে দুপক্ষের সমর্থকদের মাঝে হট্টগোল শুরু হয়। শুক্রবার ভোররাতে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনাও ঘটে। এতে কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। সেখানে একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে মারধর করা হয়। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে কারা হাতাহাতি ও মারামারি করেছে সে বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
হাতাহাতি ও মারামারির এক পর্যায়ে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের প্রধান আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ভোট গণনার সময় অন্য সম্পাদক প্রার্থীরা উপস্থিত না থাকায় সম্পাদক পদে নাহিদ সুলতানা যুথিকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো।
পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুপ্রিম কোর্টে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
তবে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, শুক্রবার (৮ মার্চ) সকাল সোয়া সাতটার দিকে আইনজীবী সমিতির বাইরের রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় তিনটি ট্রাঙ্ক পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ সেগুলো আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ব্যালট বাক্স ভেবে সংগ্রহ করে।
পরে ট্রাঙ্কগুলো সমিতির নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তরের উদ্দেশে সমিতির মিলনায়তনের ভেতরে গিয়ে আরও দুটি ট্রাঙ্ক দেখতে পায়। পরে মোট পাঁচটি টাঙ্ক নির্বাচন কমিশনের হেফাজতে দেওয়া হয়। এরপর সেগুলো সমিতির একটি রুমে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আর এগুলো অক্ষত অবস্থায় রাখতে তালাবদ্ধ রুমের বাইরে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, গত রাতে ভোটের ব্যালট পেপার বাছাই শেষে গণনার উদ্যোগ নিলে একজন সম্পাদক প্রার্থী রাতে গণনা না করে দিনের আলোতে ভোট গণনার আবেদন জানান। তখন সেখানে উপস্থিত থাকা অন্য দুজন সম্পাদক প্রার্থী আইনজীবী সমিতির নিয়ম অনুযায়ী বাছাই শেষে রাতেই ভোট গণনার দাবি করেন। এক পর্যায়ে দুজন সম্পাদক প্রার্থীর আইনজীবীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে বিশৃঙ্খলা পরিবেশ সৃষ্টি হয়, এমন সময় কয়েকটি ব্যালটবাক্স হারিয়ে যায়। এরপর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই আমরা বাসায় চলে এসেছি।
এ বিষয়ে আমার জানামতে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্তের নেওয়া হয়নি। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনারও আমাদের কিছু জানাননি।
এর আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সেশনের দুইদিনব্যাপী নির্বাচনে ৫৩১৯ জন আইনজীবী ভোট দিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ মার্চ ৩২৬১ জন আইনজীবী ভোট দেন এবং বৃহস্পতিবার ২০৫৮ জন ভোট দিয়েছেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান মনির সারাবাংলাকে বৃহস্পতিবার রাতে বলেছিলেন, দুদিনব্যাপী সুপ্রিম কোর্টের বারের নির্বাচন অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এবং কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মোট ভোটার সংখ্যা সাত হাজার ৮৮৮ জন। আজ ২০৫৮ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। এর আগে গতকাল ৩২৬১ জন ভোটার ভোট দেন।
তিনি আরও বলেন, আশা করছি নিরপেক্ষভাবে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করতে পারব।
দুদিনব্যাপী নির্বাচনে শত শত আইনজীবীদের উপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে ছিল উৎসবের আমেজ। মোট ৫০টি বুথে একযোগে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সিনিয়র-জুনিয়র সব আইনজীবীদের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে দেখা যায়।
নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনে ভোটারদের ভিড় বাড়তে পারে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া বহিরাগতরা যাতে ভোট কেন্দ্রের আঙ্গিনায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্যই ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এ বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ড. ইকবাল করিম সারাবাংলাকে বলেছিলেন, সুষ্ঠু, সুন্দর ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া প্রথম দিনে বহিরাগত কিছু লোকজনের আনাগোনা লক্ষ্য করা গেছে। বহিরাগতরা প্রবেশ করে যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
দুদিনব্যাপী আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ভোটগ্রহণ উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। আইনজীবীদের আইডি কার্ড দেখে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তবে ভোটের প্রথম দিন সাদা পোশাকে শতাধিক বহিরাগত ভোট কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে সাদা প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হক নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেন। এরপর পুলিশের সহায়তায় সাদা পোশাকে অবস্থান নেওয়া বহিরাগতদের বের করে দেওয়া হয়।
এবার সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়েরকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। ছয় সদস্যের কমিটিতে বাকি পাচজন সদস্য।
অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন হলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা বরাবরই প্যানেলভিত্তিক পরিচিতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের মনোনীত প্রার্থীরা ‘সাদা প্যানেল’-এর প্রার্থী হিসেবে হিসেবে পরিচিত। আর বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী প্যানেলের সমর্থিত প্রার্থীরা নীল প্যানেলের প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। মূলত এ দুটি প্যানেলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ১৪টি পদে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি-সম্পাদকসহ দাপ্তরিক পদ সাতটি, বাকি সাতটি সদস্য পদ। সাদা-নীল দুই প্যানেলই বরাবরের মতো ১৪টি পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। এ দুই প্যানেলের বাইরে সভাপতি পদে দুজন, সম্পাদক পদে দুজন এবং কোষাধ্যক্ষ পদে একজন নির্বাচন করছেন। অর্থাৎ এবারের নির্বাচনে মোট ৩৩ জন প্রার্থী হন।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪-২৫ মেয়াদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার) নির্বাচনের জন্য তপসিল ঘোষণা করেন সমিতির সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল। তপসিলে ৬ ও ৭ মার্চ ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়।
নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত (সাদা) প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন- সভাপতি পদে আবু সাঈদ সাগর, সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক, দুজন সহ-সভাপতি পদে রমজান আলী শিকদার ও দেওয়ান মোহাম্মদ আবু ওবায়েদ হোসেন সেতু, কোষাধ্যক্ষ পদে মোহাম্মদ নুরুল হুদা আনসারী, দুটি সহ-সম্পাদক পদে হুমায়ুন কবির ও হুমায়ুন কবির পল্লব। সাতটি সদস্য পদে সৌমিত্র সরদার রনী, মো. খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, রাশেদুল হক খোকন, মাহমুদা আফরোজ, বেলাল হোসেন শাহীন, খালেদ মোশাররফ রিপন, রায়হান রনী।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য (নীল) প্যানেল থেকে মনোনীত বিভিন্ন পদের প্রার্থীরা হলেন- সভাপতি পদে এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সম্পাদক পদে মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল), দুজন সহ-সভাপতি পদে মো. হুমায়ুন কবির মঞ্জু ও সরকার তাহমিনা বেগম সন্ধ্যা, কোষাধ্যক্ষ পদে মো. রেজাউল করিম, দুটি সহ-সম্পাদক পদে মাহফুজুর রহমান মিলন ও মো. আব্দুল করিম। সাতটি সদস্য পদে ফাতিমা আক্তার, সৈয়দ ফজলে এলাহি অভি, মো. শফিকুল ইসলাম শফিক, মো. রাসেল আহমেদ, মো. আশিকুজ্জামান নজরুল, মহিউদ্দিন হানিফ ও মো. ইব্রাহিম খলিল।
এই দুই প্যানেলের বাইরে সভাপতি পদে ইউনুছ আলী আকন্দ এবং খলিলুর রহমান বাবলু (এম কে রহমান) প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া সম্পাদক পদে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে নাহিদ সুলতানা যুথি ও ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূইয়ার প্রার্থী হয়েছে। কোষাধ্যক্ষ পদে সাদা ও নীল প্যানেলের বাইরে সাইফুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এনইউ