Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রংপুরে হাসপাতালসহ ২৪% ভবন অগ্নিঝুঁকিতে, শঙ্কিত নগরবাসী

রাব্বী হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৭ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৫ | আপডেট: ৭ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪১

রংপুর: রংপুর নগরীর অধিকাংশ বহুতল আবাসিক ভবন ও বিপণীবিতানে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা। আবার কোনো কোনো ভবন ও বিপণীবিতানে ব্যবস্থা থাকলেও তা ব্যবহারে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। অধিকাংশ এসব ভবনের মধ্যেই রয়েছে খাবারের দোকান বা রেঁস্তোরা। প্রায়শই এসব ভবন বা বিপণীবিতানে অগ্নিকাণ্ডের খবরও পাওয়া যায়। এসব কারণে ভবনগুলোতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডে বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রংপুর নগরীর বহুতল ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সিটি করপোরেশন ও সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যবস্থা নিতে চাইলেও এসব বিষয়ে তারা অনেকটা নিরুপায়।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, রংপুর মহানগরীতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ ৯৫ ভাগ ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণসহ অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিয়ম মানছেন না ভবন মালিকরা। এ কারণে দিন দিন এসব ভবনে বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি।

সম্প্রতি প্রকাশিত ফায়ার সার্ভিসের একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৭.৮৭ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাছাড়া দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৫৪ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে রংপুরের ২৪ শতাংশ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, পরিদর্শনের সময় ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি খতিয়ে দেখে ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে রংপুরের ৫১২টি ভবন পরিদর্শন করে ১২৩টি ভবনকে এই অগ্নিঝুঁকির তালিকায় নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের আগুনের ঝুঁকির তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে সরকারি এই হাসপাতালটি। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নেয় প্রায় দুই হাজারের বেশি রোগী। মাঝে মাঝেই এই হাসপাতালটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গতবছরের ডিসেম্বরেই হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

বিজ্ঞাপন

এরই কিছুদিন আগে হাসপাতালের নিচতলার প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন বিদ্যুতের প্রধান সঞ্চালন বোর্ডে (এমডিবি) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটনায় রোগীরা সবসময়ই আতঙ্কে থাকেন।

এছাড়াও ঝুঁকিতে রয়েছে কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কছিরউদ্দিন হাসপাতাল, প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর বেশির ভাগ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক।

এদিকে হাসপাতালের মতো নগরীর বেশির ভাগ বিপণীবিতানও অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। জেলা পরিষদ সুপার মার্কেট, কমিউনিটি সুপার মার্কেট, জাহাজ কোম্পানি শপিং কমপ্লেক্স, গোল্ডেন টাওয়ার, শাহ আমানত টাওয়ার, মিনি সুপার মার্কেট, সিটি বাজার, নবাবগঞ্জ বাজারসহ ছোট বড় বাণিজ্যিক ভবন ও মার্কেটগুলোতে অগ্নি নির্বাপণের নেই সামান্য ব্যবস্থা। এসব মার্কেট ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই হতে পারে বড় ধরণের প্রাণহানির ঘটনা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে প্রতিদিন হাজারও ক্রেতা আসে। এই মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রয়েছে মাত্র তিনটি গেট। বিপুলসংখ্যক ক্রেতা প্রতিদিন এই মার্কেটে এলেও অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে নেই কোনো ব্যবস্থা। সে কারণে এখানে আগত ক্রেতা ও বিক্রেতারা প্রতি মুহূর্তেই থাকেন এক ধরনের আতঙ্কে। জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের মতোই চিত্র অন্য মার্কেটগুলোরও। আর বহুতল বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে রয়েছে বেসরকারি ব্যাংক, আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলোর বেশির ভাগেই অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ও ফায়ার অ্যালার্ম নেই।

জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, ‘প্রতিমাসেই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আতঙ্কিত থাকেন ক্রেতারাও। কখন যে বড় দুর্ঘটনা ঘটে এই ভয়ে আছি। মার্কেটের কোনো দোকানেই নেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র; ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এই যন্ত্র ব্যবহারের জন্য তাগিদ দিলেও কেউ তোয়াক্কা করেন না।’

সাধারণত ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নকশা অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ এই সংস্থাটির। নকশা অনুযায়ী ভবন হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের কাজটি ঠিকমতো করে না করপোরেশন। আর ছয়তলার ওপর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, এসব ভবন ও মার্কেট দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তবে ভবন মালিকরা নিয়ম মানছেন না বলে পাল্টা অভিযোগ সিটি করপোরেশনের। ফায়ার সার্ভিস বলছে, নিয়ম অমান্যকারীদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ শুরু করছে তারা।

রংপুর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ভবন মালিক, তাদের বেশিরভাগই নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। তারা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কিরকম ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেই পরামর্শও নেয়নি। আমাদের জনবল সংকটের কারণে আমরা চাইলেও ভালোভাবে তদারকি করতে পারি না। ভবন মালিকরা নকশা অনুমোদন করে নিয়ে যান কিন্তু বাস্তবে নকশার বিপরীতে তারা কাজ করেন।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রংপুর জেলার বাদশাহ মাসউদ আলম বলেন, ‘নগরীর অধিকাংশ ভবনেই বিধিসম্মত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ভবন মালিকদের বেশির ভাগই ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমাদের টিম ভবন পরিদর্শনে মাঠে নেমেছে। যেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পাওয়া যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে। প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব আইনে ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ই-লার্নিং সেন্টারের সহকারী পরিচালক মাসুদার রহমান বলেন, ‘বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখা যেমন দরকার তেমনি জানা থাকা চাই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার পন্থা।’

দওর্যোগ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করা এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাসাবাড়ি ও বহুতল ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে একটি হলেও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখাটা খুব প্রয়োজন। অগ্নিনির্বাপণী যন্ত্র কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা চাইলে সহজেই শিখে নেওয়া সম্ভব।’

অগ্নিঝুঁকি প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রিপন বলেন, ‘অগ্নিনিরাপত্তার সঙ্গে অনেকগুলো সরকারি সংস্থা জড়িত থাকে। এসব সংস্থার মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের ঘাটতি থাকে বলে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়। যথাযথ সমন্বয় ও আইনের প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন। এজন্য জীবনের নিরাপত্তার সবাইকে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি সরকারের কঠোর হতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘ভবন মালিকরা নিয়ম মানছেন না। নগরবাসী সচেতন না হলে কিভাবে সম্ভব; সিটি সিটি করপোরেশন নকশা অনুমোদন দিচ্ছে হয়তো ৫ তলার কিন্তু ভবন মালিক বানাচ্ছেন ৮ তলা বিল্ডিং। যারা নিয়ম মানছেন না করপোরেশন তাদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ শুরু করবে দ্রুতই।’

সারাবাংলা/এমও

অগ্নিঝুঁকি টপ নিউজ নগরবাসী রংপুরে হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন

রিশাদ-জাহানদাদে কুপোকাত সিলেট
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:২১

আরো

সম্পর্কিত খবর