Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অফিসের অনুমোদনে রেস্তোরাঁ, ‘বন্ধ’ টুইন পিকে রাজউকের অভিযান

ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
৫ মার্চ ২০২৪ ০১:২৮ | আপডেট: ৫ মার্চ ২০২৪ ১১:৫৪

গাউছিয়া টুইন পিক। ফাইল ছবি

১৪ তলা ভবনটির নাম গাউসিয়া টুইন পিক। অবস্থান রাজধানীর ধানমন্ডিতে, সাত মসজিদ রোডের একেবারে মাঝামাঝি এলাকায়। চাপ ঘর, কাভান সিগনেচার, আদি কড়াই গোস্‌ত— এরকম স্বনামধন্য সব রেস্তোরাঁর অবস্থান এই ভবনে। এখানেই শেষ নয়! দ্য লবি বুফে, হোয়াইট হল বুফে, প্যান প্যাসিফিক লাউঞ্জ, মেরিটেজ ঢাকার মতো বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বুফে রেস্তোরাঁর অবস্থানও এই একটি ভবনেই। ছাদে রয়েছে রুফটপ রেট্রো লাইভ কিচেনও। এরকম একটি ভবন ভোজনরসিকদের জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।

বিজ্ঞাপন

খাদ্যপ্রেমীদের আনাগোনায় জমজমাট একটি ভবন, যেখানে ১৪ তলা মিলিয়ে রেস্তোরাঁর সংখ্যাই প্রায় ১৫টি, সেই ভবনটি কি না রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিতই নয়! হ্যাঁ, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় যখন ফের ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায়, তখনই জানা গেল— গাউসিয়া টুইন পিক প্রায় পুরোটাই রেস্তোরাঁয় ভর্তি হলেও ভবনটির অনুমোদন মূলত অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য! আবার এরকম ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও এগুলোর মালিকরা ঠিকই জোগাড় করেছেন সরকারি বিভিন্ন দফতর থেকে!

বিজ্ঞাপন

বেইলি রোডের আগুনের পরদিনেই গাউসিয়া টুইন পিক এসেছিল আলোচনায়। ভবনটির স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ নিজেই ফেসবুক পোস্ট দিয়ে জানিয়েছিলেন, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছে ভবনটি। তিন দিন পর আজ সোমবার (৪ মার্চ) রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবনটিতে অভিযান চালিয়েছে।

আরও পড়ুন- ভবনে আগুন: ক্রেতাশূন্য বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ-শপিং মল

অভিযানে রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও দেখতে পেয়েছেন একই চিত্র। অফিস হিসেবে অনুমোদন নেওয়া ফ্লোরে দিব্যি চলছে রেস্তোরাঁ। পার্থক্য হলো— অন্যান্য দিন ভরদুপুরে যখন এসব রেস্তোরাঁ থাকে কানায় কানায় পূর্ণ, এদিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে দেখলেন, গোটা ভবন যেন খাঁখাঁ করছে! বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাজউক অভিযান চালাবে— এমন খবর পেয়েই মালিকরা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দিয়েছেন রেস্তোরাঁগুলো!

গাউসিয়া টুইন পিকে রাজউকের অভিযান শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। অভিযানে যে কয়েকটি রেস্তোরাঁ বন্ধ পাওয়া গেছে, তার সবগুলোই সিলগালা করে দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আর ছাদে যে রুফটপ রেট্রো লাইভ কিচেন, সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই ভবনের নকশায়। সেটি একদম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অভিযানে। একটি রেস্তোরাঁর মালিক অভিযানের সময় উপস্থিত ছিলেন। তাকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সোমবার গাউছিয়া টুইন পিকে অভিযান চলে রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পরিচালক তাজিনা সারোয়ারের নেতৃত্বে। ছবি: সারাবাংলা

পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যদের নিয়ে রাজউকের এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার। তিনি জানান, যে নকশায় গাউসিয়া টুইন পিককে রাজউক অনুমোদন দিয়েছে, সেই নকশা অনুযায়ী এভাবে বিভিন্ন তলায় রেস্তোরাঁ বসানোর সুযোগ নেই। মূল নকশায় ছাদ একেবারেই খোলামেলা। অথচ অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব রেস্তোরাঁকে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে, কলকারখানা অধিদফতর ও ফায়ার সার্ভিস ছাড়পত্রও দিয়েছে বলে জানাচ্ছে রাজউক।

কী আছে টুইন পিকে

গাউসিয়া টুইন পিক নামের ভবনটির নিচতলায় রয়েছে ফার্মেসি ‘লাজ ফার্মা’, মোবাইল ফোন ও মোবাইল অ্যাকসেসরিজের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘গ্যাজেটস অ্যান্ড গিয়ার’ এবং পোশাকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘সেইলর’। তৃতীয় তলায় ব্র‍্যাক ব্যাংকের শাখা।

এর বাইরে ভবনের বাকি প্রতিটি অংশেই একের পর রেস্তোরাঁ। কালচার অ্যান্ড কুইজিন, স্পাইস অ্যান্ড হার্বস, চাপ ঘর, ইয়াম চা, ক্যাফে সাও পাওলো, ক্যাফে ডলস— জনপ্রিয়তায় কেউ কারও চেয়ে কম নয়। বাকি রেস্তোরাঁগুলোর নাম ওপরে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে বুফে রেস্তোরাঁগুলোর কথাও। রেস্তোরাঁগুলো রেখে যখন মালিক-কর্মীরা লাপাত্তা, রাজউকের অভিযানে প্রায় সবগুলোই করে দেওয়া হয়েছে সিলগালা।

আরও পড়ুন- গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো রুফটপ রেট্রো লাইভ, আরও ১২ রেস্তোরাঁ সিলগালা

‘বন্ধ’ রেস্তোঁয় সিলগালা অভিযান

গাউসিয়া টুইন পিকে প্রবেশ করেই সদলবলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিন সারোয়ার চলে যান ভবনটির ছাদে। সেখানে অবস্থান রেট্রো লাইভ কিচেন রুফটপ রেস্তোরাঁর। অথচ ভবনের নকশায় ছাদটি দেখানো হয়েছে খোলামেলা। অর্থাৎ নকশায় সেখানে কোনো রেস্তোরাঁ নেই। সে কারণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে অবৈধভাবে নির্মাণ করা রেস্তোরাঁটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

এরপর একদম ওপর তলা থেকে পরিদর্শন শুরু করেন নির্বাহী মাজিস্ট্রেট। বহির্গমন সিঁড়ি দিয়ে একতলা করে নামতে থাকেন। প্রতিটি তলাতেই রেস্তোরাঁ এবং দুয়েকটি তলায় থাকা অন্য দোকানগুলোর প্রতিটিতে যান তিনি। এ সময় অবশ্য অধিকাংশ রেস্তোঁরাই তিনি বন্ধ পান।

তালাবদ্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুকতে পারেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিন সারোয়ার। যেসব রেস্তোরাঁ তিনি তালাবদ্ধ পেয়েছেন, সেগুলো সিলগালা করে দিয়েছেন। অন্য কয়েকটি রেস্তোরাঁর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।

ভবনটির অষ্টম তলায় আছে ‘কে ড্রোব’ নামের একটি ফ্যাশন হাউজ। সেখানেও এ ধরনের দোকানের অনুমোদন নেই। অভিযানের একপর্যায়ে সেখানে পৌঁছান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিন সরওয়ার। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীকে ডেকে ঈদ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তিনি। বলেন, মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে ঈদ পর্যন্ত ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হবে। এরপর যেন দোকান সরিয়ে নেওয়া হয়।

অভিযানে বন্ধ থাকা রেস্তোরাঁগুলো সিলগালা করা হয়। ছবি: সারাবাংলা

রাজউকের এই অভিযানের সময় নিজের রেস্তোরাঁয় উপস্থিত ছিলেন কেবল ‘স্পাইস অ্যান্ড হার্বস’ রেস্তোঁরার স্বত্বাধিকারী। দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে। পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আমি কি চোর? ল্যান্ডলর্ড বলেছে আজ রেস্তোরাঁ খুলতে। আমরা খুলেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল পুলিশ এসে ৩০ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। ওরা কেউই মালিক না। তাদের দোষ কোথায়? জেলে যাওয়া মানেই তো তাদের জীবনে স্পট লেগে যাওয়া। তাদের দোষটা কী আসলে?’

যা বলছে রাজউক

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা রাজউক পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিন সারোয়ার বলেন, এই ভবনটি ‘এফ ওয়ান’ ক্যাটাগরিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মূলত অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই ক্যাটাগরির ভবন অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ভবনটি পরিদর্শন করে আমরা মাত্র দুটি তলার কিছু অংশ অফিস হিসেবে ব্যবহার হতে দেখেছি। ভবনের বাকি প্রায় পুরোটাজুড়েই রেস্তোরাঁ বসানো হয়েছে। কয়েকটি কাপড়ের দোকান ও একটি ওষুধের দোকানও পেয়েছি।

তাজিন সারোয়ার আরও বলেন, অনুমোদনহীনভাবে এরকম ভবনে রেস্তোরাঁ করতে দেওয়া যায় না। আর ছাদের রেস্তোরাঁটি তো নকশার মধ্যেই নেই। সেটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো সিলগালা করেছি। কয়েকটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যারা অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় সে জন্য রাজউক ছাড়াও সিটি করপোরেশন কিংবা কলকারখানা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অবগত করব।

গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ওই অগ্নিকাণ্ডের পর স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গাউসিয়া টুইন পিকে যেতে ভোক্তাদের নিষেধ করেন।

ভবনটির নকশও করেছিলেন স্থপতি মুস্তাফা খালিদ। তিনি বলেন, ভবনটির নকশা তিনি যেভাবে করেছিলেন, সেভাবে আর ভবনটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। মূলত অফিস স্পেস হিসেবে ভবনটির নকশা তৈরি করা হলেও সেখানে একের পর এক বিধি বহির্ভূতভাবে রেস্তোরাঁ চালু করা হয়েছে।

সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর

গাউছিয়া টুইন পিক টাওয়ার টপ নিউজ টুইন পিক টাওয়ার রাজউক রাজউকের অভিযান রেট্রো লাইভ কিচেন রেস্তোরাঁ সিলগালা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর