পোড়াদহ মেলায় নজর কেড়েছে ৪০ কেজি ওজনের পাখি মাছ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৩২ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৪
বগুড়া: বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহের মেলা। কেউ বলে মেলার বয়স ২০০ বছর আবার কেউ বলে ৪৫০ বছর। বয়স নিয়ে তর্ক থাকলেও মেলাটি যে প্রাচীন ও ঐতিহ্য বহন করছে তা নিয়ে কারও মতভেদ নেই। এই মেলা এলে জেলাজুড়েই উৎসব বয়ে যায়। মেলা একদিনের তবে আবহ থাকে কয়েকদিন।
বগুড়া সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্বে ইছামতির তীরে পোড়াদহ এলাকায় বসে এ মেলা। সবার কাছে এটি ‘পোড়াদহ’ মেলা নামেই সর্বাধিক পরিচিত। কালের আবর্তে এ মেলাতে লোকজনের উপস্থিতি বেড়ে পরিণত হয়েছে মেলবন্ধনে। পোড়াদহ মেলা মানেই বিশাল আকৃতির ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মেলা।
প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ঐতিহ্যবাহী এই মেলার আয়োজন হয়। গাবতলীর পোড়াদহ সহ আশপাশের চারটি উপজেলার প্রায় ২০০ গ্রামে এক দুই মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, বগুড়ার গাবতলীর ঐতিহ্যবাহী এই পোড়াদহ মেলা সাড়ে ৪শ’ বছর আগ থেকে হয়ে আসছে। সন্ন্যাসীর মেলা দিয়ে শুরু হয়ে পোড়াদহ মেলা কালের বিবর্তনে এখন মাছের মেলা। এলাকায় প্রসিদ্ধ জামাই মেলা নামে।
মেলাকে ঘিরে ঘরে ঘরে চলে জামাই বরণের পালা। ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি আর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে উৎসবের ধুম পড়ে পূর্ব বগুড়ার গাবতলী, সারিয়াকান্দি, শাজাহানপুর ও ধুনট সহ চার উপজেলায়। মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রামের বিবাহিত নারীরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এ ছাড়া তাদের আত্মীয়স্বজনকেও বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা হয়। বলা যায় গোটা এলাকায় দাওয়াতের ধুম পড়ে যায়।
বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) মেলায় সবার নজর কেড়েছে ৪০ কেজি ওজনের পাখি বা সেইল ফিস। সাত ফুট দৈর্ঘ্যর মাছটির দাম হাঁকা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলে ব্যবসায়ী শরিফ তালুকদার জানালেন প্রতিকেজি দুই হাজার টাকা হিসেবে এ দাম হাঁকা হয়েছে।
মেলায় রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, সিলভার কার্প, বিগ্রেড, কালবাউস, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সমাহার ছিল দেখার মত।
মেলায় প্রতি বছরের মতো বাহারি মিষ্টান্ন সামগ্রী ছিল আরেক আকর্ষণ। মাছ আকৃতির মিষ্টি, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপি, নিমকি, তিলের নাড়ু, খই, শুকনা মিষ্টি উঠেছিল দোকানগুলোতে।
আল আমিন মিস্টি ভান্ডারের কারিগর আব্দুল বারি বানিয়েছেন ১২ কেজি ওজনের মাছ আকৃতির মিষ্টি। মেলা উপলক্ষ্যে এই মিষ্টি বানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
মেলায় ছিল চটপটি-ফুচকাসহ মুখরোচক নানা পদের খাবারের দোকান ছিল। এছাড়াও মেলার বাহারি ডিজাইনের কসমেটিকস, খেলনা, গিফট সামগ্রী, চুড়ি, কানের দুল, মালা, কাজল, মেকআপ বক্স, ব্যাট, বল ভিডিও গেমসসহ নানা ধরণের প্রসাধনী ও খেলনা সামগ্রীও ছিল।
বিনোদনের জন্য ছিল সার্কাস, নৌকা খেলা, কার খেলা, যাদু, নাগোরদোলা, চরকি, দোলনা, কুপে হোন্ডা চালনা, পুতুল নাচ ও ভেলকীবাজি সহ নানা আয়োজন। এছাড়া কাঠ ও স্টিলের খাট পালংসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মেলা উপলক্ষে এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। এ উপলক্ষে আশপাশের গ্রামের বিবাহিত নারীরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এ ছাড়া তাঁদের আত্মীয়স্বজনকেও বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা হয়।
মেলার মূল আকর্ষণ ছিল বড় বড় বাঘাইড় মাছ। কিন্তু গতবছর থেকে মেলায় বাঘাইড় মাছ কেনাবেচা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যার কারণে মেলায় আর বাঘাইড় মাছ ওঠে না। এই মেলাকে ঘিরে উপজেলার দুর্গাহাটা হাইস্কুল মাঠ, সুবোধ বাজার, দাড়াইল বাজার, নাড়ুয়ামালাহাট সহ কয়েকটি স্থানে মেলা বসানো হয়েছে।
ছেলেকে নিয়ে পোড়াদহ মেলায় এসেছেন মাহমুদুল আলম নয়ন। কথা হলে তিনি বলেন, ছেলের আবদার মেটাতে মেলায় এসেছি। খুব ভালো লাগছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী আবু তাহের বলেন, আমি বগুড়ার জামাই তাই মেলায় এসেছি। প্রতিবছরই মেলায় আসার চেষ্টা করি। এবার মেলায় মাছের দাম একটু বেশি। আমি দুটো মাছ কিনেছি একটি এক হাজার টাকা, অন্যটি ৬০০ টাকা।
মেলায় এসেছেন আব্দুল খালেক। তার বাড়ি মেলা এলাকায়। তিনি জানান, মাছের জন্যই এ মেলা। জৌলস হচ্ছে মাছ, অনেক বড় বড় মাছ ওঠে। তবে দিন যত যাচ্ছে মেলা তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে।
স্ত্রী জহুরা বেগমকে নিয়ে মেলায় এসেছেন বগুড়ার বাসিন্দা আজিজ মন্ডল। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী এই মেলা দেখেননি। তাই নিয়ে এসেছি। সে খুবই খুশি। ভাবছি বড় একটা মাছ কিনব। সেইজন্য ঘুরে ঘুরে দেখছি।
মেলায় তিন শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রতিটি মাছের দোকানে ৫ থেকে ১০ মণ মাছ ওঠে। এসব দোকানে কয়েক কোটি টাকার মাছ কেনা-বেচা হয়।
মাছ ব্যবসায়ীরা আরও জানালেন, এবার মাছের আমদানি বেশি হলেও দাম গত বছরের চেয়ে কম।
তবে ক্রেতাদের বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিযোগ মাছের দাম বেশি।
মিষ্টি বিক্রেতা মুঞ্জরুল হক বলেন, কয়েকশ বছর আগে এটি ছিল সন্ন্যাসের মেলা। অনেক পরে এলাকার নাম অনুসারে হয় পোড়াদহের মেলা। মেলায় উঠত বড় মাছ ও নানান রকম মিষ্টি। সেই ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছি। ঐতিহ্য হচ্ছে মাছ আকৃতির বিভিন্ন সাইজের মিষ্টি। আমি এক কেজি থেকে ১০ কেজি ওজনের মিষ্টি নিয়ে এসেছি। বিক্রিও ভালই হচ্ছে।
গাবতলী ইউএনও নুসরাত জাহান বন্যা এবং গাবতলী মডেল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, মেলাটি সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
পোড়াদহ সন্ন্যাসী মেলা পূজা কমিটির সভাপতি নিকুঞ্জ কুমার পাল দাবি করেন, মেলা প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের পুরানো। তাদের হিসাব অনুযায়ী এবার ৪৫২তম মেলা হচ্ছে। সন্ন্যাসী পূজা কেন্দ্র করে মেলা শুরু হলেও এখন রূপ নিয়েছে সর্বজনীন উৎসবে।
সারাবাংলা/এনইউ