ইবিতে ফের বিবস্ত্র করে র্যাগিং: ‘ও কথায় কথায় হাসে এজন্য মারছি’
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:২২ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:২৭
ইবি: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে র্যাগিং, বিবস্ত্র করে রড দিয়ে মারধর, পর্নগ্রাফি দেখানো ও টেবিলের ওপর কাকতাড়ুয়া বানিয়ে রাখার অভিযোগ ওঠেছে। অভিযুক্তদের আলাপ থেকে জানা গেছে, ‘কথায় কথায় হাসা’র অভিযোগে ওই শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতেই ‘মারধর’ করা হয়েছিল।
গত বুধবার ইবির লালন শাহ হলের গণরুম তথা ১৩৬ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। ইবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিষয়টি ‘ঘরোয়াভাবে সমাধান’ করায় এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে ‘বিশেষ চাপ’ দেওয়ায় এ ঘটনায় কোনো অভিযোগ প্রশাসনের কাছে জমা পড়েনি। গতকাল সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ঘটনাটি জানাজানি হয়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) লালন শাহ হলের গণরুমের দায়িত্বে থাকা ‘বড় ভাই’ নাসিম আহমেদ মাসুম। মাসুম অর্থনীতি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি শৈলকূপায়। ঘটনার পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত ও ভূক্তভোগীদের নিয়ে ১৩৬ নং কক্ষে (গণরুমে) অনুষ্ঠিত ‘সমঝোতা বৈঠক’ হয়। সেই বৈঠকের একটি অডিও ক্লিপ সারাবাংলার প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
আরও পড়ুন- ইবিতে বিবস্ত্র করে র্যাগিং: এবার প্রশাসনের তদন্ত কমিটি
সেখানে মাসুম ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বলেছেন, ‘আমার রুমে গেলি, আমাকে কিছু বলিসনি। তোর কী বলা উচিত ছিল না? হল চালাই আমি দায়ভার আমার। নিউজ হলি তো আমার নামে হইতো। আমাকে জানাননি তোর জেলা কল্যাণের ভাইকে জানাইছিস। তাইলে কথাটা বাইরে গেলো কী করতি? তোরে হলে তুলেছে একজন। দায়ভার আরেকজনের। বিচার দিতে যাস আরেক ভাইয়ের কাছে। সেই ভাই তো তোরে প্রক্টরের কাছে নিয়ে গেছে।’
বিবস্ত্র করে র্যাগিংয়ের ঘটনা যেন জানাজানি না হয় সেজন্য কয়েক দফায় বৈঠক করেছিল হলের কয়েকজন ‘বড় ভাই’। এতে অন্তত ২০ জন উপস্থিত ছিল। বৈঠকের ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের একটি অডিও প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে নির্যাতনের ভয়াবহতা ও বাইরে যেন জানাজানি না হয় সে জন্য হুমকিধামকি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে র্যাগিংয়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন। অভিযুক্তরা হলেন- শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুদাচ্ছির খান কাফি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাগরসহ অন্তত ৫ জন।
আরও পড়ুন- ইবিতে গণরুমে ফের র্যাগিং: হল কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি
এদিকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের উজ্জল হোসাইন ও ল’ এন্ড ল্যন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ইউসুফ সানী নামে দুই শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। উভয়ই ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, ‘মিটমাট’ করার উদ্দেশ্যে ভূক্তভোগী ও অভিযুক্তদের নিয়ে ১৩৬ নং কক্ষেই বসেন হলের কয়েকজন ‘বড় ভাই’। অডিও এবং গণরুমে থাকা ছাত্রদের থেকে জানা যায়, বড় ভাই মাসুম সবার সঙ্গে কথা বলে সমস্যা জানতে চান। এসময় মাসুম জুনিয়রদের বলেন, পরিচয় হসনি! এই জায়গায় কয়টা সিনিয়রকে চিনিস। এখানে সবার নাম বল?
এসময় এক জুনিয়র হেসে উঠলে ধমক দিয়ে মাসুম বলেন, ‘কতদিন রুমে থাকিস এদের চিনিস না? অনেকক্ষণ দাঁড়া করাই রাখছে তাই বলে হেনস্তা হয়ে গেলো? তোর আগেও নাকি ২-৩ বার এরকম হইছে। তোর সাথেই কেন এমন হইছে। আর কারো সাথে তো হয়নি। তোর কোনো দোষ নাই?’
তখন ভুক্তভোগী মাসুমকে বলেন, ‘গতরাতে (৭ ফেব্রুয়ারি) নাকে আমাকে খত দেওয়া হয়েছিল। রড দিয়ে মারা হয়েছিল। গালিগালাজ করা হয়েছিল। মা-বাপ তুলে গালি দেওয়া দিয়েছে। ৫ মাস ধরে এ অত্যাচার সহ্য করছি। আমরা সিনিয়রদেরকে কোনভাবে সন্তুষ্ট করতে পারছি না। সবসময় তারা আমাদের সঙ্গে এসব কাজ করে আসছে। আমাদের উলঙ্গ করছে। অশ্লীল ভিডিও দেখাইছে।’
মাসুম এসময় বলেন, ‘তুই পুরুষ মানুষ না! ছাড়ছে তো কি হইছে?’ এছাড়া ভূক্তভোগী তার নির্যাতনের বর্ণনা দিতে মাসুমসহ সকলে মিলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অশ্লীল গালিগালাজ, গোপনাঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা বলেন ও হাসাহাসি করেন। (কথোপকথন পাঠপোযোগী ও প্রকাশযোগ্য নয়)
একপর্যায়ে অভিযুক্তরা বলেন, ‘ও কথায় কথায় হাসে এজন্য মারছি।’
এরপর মাসুম গালি দিয়ে অভিযুক্তদের বলেন, ‘ও হাসাহাসি করুক আর যাই করুক, সে জন্য তোরা মারবি? প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেওয়া হলে যে কয়েকজনের নাম আছে সে কয়েকজনই বহিষ্কার হতো। যদি আমার নাম আসতো, আমি ডিরেক্ট বলে দিতাম, আমি জানি না কিছু কারণ এ জায়গায় আমি উপস্থিত ছিলাম না। এ বিষয় নিয়ে যেন আর কোন কথা না হয়, এসব বাইরে যাবে না।’
আরও পড়ুন- ইবিতে ফের শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে র্যাগিংয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ
এক ছাত্রলীগ কর্মী জানান, শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী মাসুম। জয় নেতা হওয়ার পর লালন শাহ হলে উঠলে মাসুম গণরুম দেখাশোনা করেন এবং শিক্ষার্থীদের তোলেন।
অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিম আহমেদ মাসুম বলেন, ‘আমি হল চালানোর কেউ না। হল চালায় প্রশাসন। আর র্যাগিংয়ের যে ব্যাপারটা, তেমন কিছুই না। সিনিয়র-জুনিয়রদের মাঝে ঝামেলা হয়েছিল। ওরাই মিউচ্যুয়াল করেছে। আমি শুধু এমনিই উপস্থিত ছিলাম।’
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, ‘আমরা অভিযুক্তের পক্ষ নিইনি। ভূক্তভোগী যেন ন্যায়বিচার পায় এজন্য আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছি।’
এদিকে গণরুমে র্যগিংয়ের ঘটনায় পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি করেছে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৭ কার্যদিবস সময় দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছে হল প্রশাসন।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পৃথক তদন্ত কমিটিকে যথা শিগগিরই সম্ভব তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের গণরুমে এক শিক্ষার্থীকে রাতভর র্যাগিং, নগ্ন করে রড দিয়ে মারধর, পর্নগ্রাফি দেখানো ও টেবিলের উপর কাকতাড়ুয়া বানিয়ে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সারাবাংলা/এমও
ইবিতে র্যাগিং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টপ নিউজ বিবস্ত্র করে র্যাংগং