যুদ্ধে সব হারালেও স্বীকৃতি পাননি সতীশ চন্দ্রসহ ১৩ মুক্তিকামী
২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:১০
কক্সবাজার: ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ঘিরে দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে নানা ক্ষতের চিহ্ন। তেমনি এক স্মৃতি বিজড়িত জায়গা হলো কক্সবাজারের খুরুশকুলের দক্ষিণ হিন্দুপাড়া। যেখানে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সতীশ চন্দ্র দে’সহ ১৩ জন মুক্তিকামীকে। ওই সময় তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল গ্রামের বাড়ি-ঘরও।
কক্সবাজার শহর থেকে কিছু দূরে খুরুশকুল দক্ষিণ হিন্দুপাড়া। যেখানে এখনও ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার চিহ্ন রয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা তৎকালীন জমিদার সতীশ চন্দ্র দেসহ ১৩ জনকে। ওই সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ হিন্দুপাড়ার বেশিরভাগ ঘরবাড়ি। সেই ঘরবাড়ি এখন আর না থাকলেও রয়েছে ক্ষতের চিহ্ন।
জমিদার সতীশ চন্দ্র শুধু একজন মুক্তিকামী মানুষই ছিলেন না, ছিলেন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিও। নিজ সম্পত্তি দান করে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান ‘দক্ষিণ খুরুশকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এলাকার লোকজন গর্ববোধ করেন এই মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ নিয়ে।
তবে স্বীকৃতি না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মনে রয়েছে চাপা কষ্ট। তাদের অভিমান, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার পরেও ন্যূনতম স্বীকৃতি পাননি সতীশ চন্দ্র মহাজন।
মুক্তিযোদ্ধা সতীশ মহাজনের একমাত্র ছেলে সুনীল বরণ দে বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন এলাকার প্রভাবশালী মহাজন। তিনি ছিলেন মুক্তিকামী। তাই তিনিই হয়েছিলেন রাজাকারদের প্রথম টার্গেট। ১৯৭১ সালের মার্চের দিকে পাকহানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে এসেছে, জানতে পেরে রাজাকাররা পরিকল্পিতভাবে আমার বাবাকে কক্সবাজার থানায় নিয়ে বন্দি করে। সঙ্গে আমার জেঠাতো ভাইও ছিলেন। তিনি বাবার সঙ্গেই থাকতেন সবসময়। ওই সময় বাবাসহ জেলার আরও ১৩ জন মুক্তিকামীকে থানায় বন্দি করে রাখা হয়।’
‘এর এক সপ্তাহ পর পাকহানাদার বাহিনী কক্সবাজার এসে পৌঁছালে বাবাসহ ১৩ মুক্তিকামীকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর তাদের আর খবর পাওয়া যায়নি। শুনেছি তাদের সবাইকে কক্সবাজার বিমানবন্দরসংলগ্ন বাঁকখালী নদীর ওখানে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি পুড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের ঘরবাড়িসহ গ্রামের পর গ্রাম। তখন পরিবার নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমার চলে যাই আমরা’, বলেন সুনীল বরণ দে।
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ৮ মাস পর দেশে ফিরে আসি। বাড়ির সবকিছু পুড়িয়ে ফেলায় একটি ছবি ছাড়া বাবার তেমন কোন স্মৃতি ছিল না। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্ববোধ করি। প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের প্রতি কোন অভিযোগ নেই। তবে কষ্ট লাগে কক্সবাজার শহিদ মিনারে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বাবার নাম নেই। আমরা কোন অর্থ চাই না। আমরা চাই মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্বীকৃতি।’
সতীশ চন্দ্র মহাজনের নাতি সুমন দে বলেন, ‘আমাদের পরিবার ছিল যৌথ পরিবার। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার দাদাকে স্বাধীন দেশে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।’
স্থানীয় মো. জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সতীশ চন্দ্র মহাজনকে নিয়ে আমাদের অহংকার হয়। কিন্তু কষ্ট লাগে, যখন জানতে পারি এখনও তিনি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বা স্বীকৃতি পাননি। এটি পুরো এলাকার জন্য হতাশার বিষয়।’
স্কুল শিক্ষক ধ্রুব সেন জানান, ‘সতীশ চন্দ্র মহাজন শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, তিনি এলাকার লোকজনকে শিক্ষিত করার জন্য নিজের সম্পত্তি দান করেছেন। যেটি আজ দক্ষিণ খুরুশকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।’
কক্সবাজারের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী জানান, সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সহযোগিতায় খুরুশকুলের সতীশ চন্দ্র দেসহ আরও অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে এই বাহিনী সারা দেশের মতো কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে। যা খুবই কষ্টদায়ক।’
তিনি আরও বলেন, “স্বাধীন দেশে এখনও সতীশ চন্দ্র দে’র মত অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার রয়েছে। সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, এই শহিদ পরিবারগুলোর খোঁজ নিয়ে যেন যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়।”
সারাবাংলা/এমও