‘শিবিরের বিজয় দিবস উদযাপন ইতিহাসের সঙ্গে ভণ্ডামি‘
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০১:১৬ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৫৪
ঢাকা: বিজয়ের ৫২ বছরপূর্তি উদযাপনের মুখে দাঁড়িয়েছে জাতি। সারাদেশ একাত্তরের বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত। ঠিক এমন সময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, যাদের প্রতিষ্ঠাতারা একাত্তরে অবস্থান নিয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। শুধু তাই নয়, একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী সব অপরাধেই তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশেও তারা কখেনো নিজেদের অতীত স্বীকার করেনি বা ক্ষমাও চায়নি।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পর এসে সেই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের বিজয় দিবস উদযাপনকে স্রেফ ভণ্ডামি বলে আখ্যা দিচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকরা। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে তারা বলছেন, স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধীদের এসব কর্মসূচি স্রেফ ভণ্ডামি ও তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল। রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পেরে তারা এসবের আশ্রয় নিয়েছে। অথচ একাত্তরের ভূমিকার জন্য তারা এখনো ক্ষমাই চায়নি। এই অপকৌশল রুখতে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তারা।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচির একটি পোস্টার প্রকাশ করে ছাত্রশিবির। তাতে র্যালি ও আলোচনা সভা থেকে শুরু করে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত, বীর মুক্তিযদ্ধাদের সংবর্ধনা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ অনলাইন-অফলাইনে নানা কর্মসূচির উল্লেখ রয়েছে।
অথচ এই ছাত্রশিবির স্বাধীনতার আগে ছিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘ, যা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন। শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাশেম আলী এবং দ্বিতীয় সভাপতি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দুজনেই গণহত্যা, ধর্ষণসহ একাত্তরে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। জামায়াতে ইসলামী বা শিবির কখনোই একাত্তরে তাদের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা পর্যন্ত করেনি। উল্টো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার বিপক্ষে তারা সরাসরি অবস্থান নেয়।
সেই ছাত্রশিবিরের বিজয় দিবসের ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষণা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অধিকারকর্মী সুলতানা কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রশিবির আর জামায়াতে ইসলামীকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবেই দেখি। এর ঐতিহাসিক ভিত্তিও আছে। এই প্রজন্মের শিবির হয়তো তার ভাগীদার হতে চায় না। কিন্তু সেটা তারা আগে স্বীকার করুক যে ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকাকে তারা অনুমোদন করে না এবং এর জন্য তারা ক্ষমাপ্রার্থী। উদযাপনের মধ্যে তো শ্রদ্ধা, ভক্তি, আন্তরিকতা ও সততা থাকতে হবে। তাদের কর্মসূচির মধ্যে সেই সততা রয়েছে, একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত সেটা আমরা কী করে ভাবব?’
শিবিরের বিজয় দিবসের র্যালির জন্য প্রশাসনের অনুমতি প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, ‘তাদের অনুমতি না দিলে প্রশাসন কাকে অনুমতি দেবে আর কাকে বাধা দেবে, এই প্রশ্ন সামনে চলে আসবে। ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ডকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই প্রতিহত করতে হবে।’
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, লেখক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক শাহরিয়ার কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিবিরকে কোনো কার্যক্রমই করতে দেওয়া উচিত না। ওদের কী অধিকার আছে বিজয় দিবস উদযাপনের যারা গণহত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছে? ১৯৭১ সালে ওরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ওই সময়ে ওদের কাগজপত্রেও এসবের উল্লেখ আছে। সংবাদপত্রেও মুক্তিযোদ্ধাদের কাফের বলেছে।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর ছেলে একবার বলেছে, তারা নাকি পূর্ব পাকিস্তানে ৩৫ লাখ কাফের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছে। এভাবে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে ওরা মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে। আজ যদি সরকার ওদের পাবলিকলি বিজয় দিবস পালনের অনুমতি দেয়, সেটি হবে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানির সমতুল্য। ওরা নিজেদের অফিসের মধ্যে যা খুশি করুক।’
মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রসঙ্গে এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীতেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিয়েছেন, যাদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়েছে। তরুণদের বিভ্রান্ত করতে, প্রভু আমেরিকাকে দেখাতে এখন তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হিসেবে দেখানোর জন্য এসব করছে। এটি নষ্ট রাজনীতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সব বীর মুক্তিযোদ্ধকে এগিয়ে আসতে হবে।’
ছাত্রশিবির যে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে, সেই ধর্মের ভাষাতেই শিবিরের বিজয় দিবস উদযাপনকে ‘মুনাফেকি’ বলে আখ্যা দিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এটা স্পষ্টতই হিপোক্রেসি বা ভণ্ডামি, ইসলাম ধর্মে যাকে বলা হয় মুনাফেকি। তারা যে গিরগিটির মতো রঙ বদলায়, এটি তার প্রমাণ।
সিপিবি সভাপতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ইসলামী ছাত্রশিবির ছিল ছাত্রসংঘ। তারা একই মতাদর্শ ধারণ করছে, সেই মতাদর্শ থেকে একচুলও নড়েনি। এই ইসলামী ছাত্রসংঘ বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল। তারা তাহলে কোন বিজয় দিবস পালন করছে? তারা তো যুদ্ধাপরাধী সংগঠন। এটি একটি প্রহসন। তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আবেগ দেখে তাদের এই রঙ বদল।’
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানা সময়ে নানাভাবে বিকৃত করা হয়েছে। শিবির সেই বিকৃতির সুযোগ নিচ্ছে বলেও মনে করেন শাহ আলম। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভেদের কারণে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছে। জামায়াতে ইসলামী ও গোলাম আজমকে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব এককভাবে নিতে চায়। এসবের সুযোগ নিয়ে জামায়াত তথা ছাত্রশিবির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন প্রহসন করতে পারছে।’ এটি রুখতে তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন সিপিবি সভাপতি শাহ আলম।
শহিদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের এই কর্মসূচিকে ধোঁকা দেওয়ার প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন। বলছেন, আলোচনায় আসার জন্যই তারা এমন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
শাওন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ রাখতে পারিনি বলেই সেই সুযোগ নিচ্ছে ওরা। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে বলে কিছু থাকতে পারে না। যারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে, তাদের সবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরই থাকার কথা। কিন্তু ওরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সে কৃতকর্মের জন্য কখনো ক্ষমাও চায়নি। আজ তারা বিজয় দিবস পালনের নামে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রাজাকারদের তালিকায় ওদের নাম থাকাটা ওরা মেনে নিতে পারছে না দেখেই ওরা এখন এসব কাজ করার চেষ্টা করছে, যা আসলে করবে কি না তা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। আর যদি করেও আমরাই এটি প্রতিহত করব।’
আরেক শহিদ বুদ্ধিজীবী আলিম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘এই দেশটাই তো ওরা চায়নি, ওরা কীসের বিজয় দিবস পালন করছে! এ দেশের বিরোধিতা করে ওরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। সেই কৃতকর্মের জন্য ওরা আজ পর্যন্ত ক্ষমাও চায়নি। তাই আমার প্রশ্ন— ওরা বিজয় দিবস উদযাপন করার কে? এটি একধরনের মুনাফেকি, অপরাজনীতি। ওদের এই কর্মসূচি শহিদদের স্মৃতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন।’
‘আমি মনে করি না কোনো মুক্তিযোদ্ধা তাদের কাছ থেকে সম্মাননা নেবে। যারা নেবে তারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, রাজাকার। সরকারে উচিত এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখানোর জন্য তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা,’— বলেন নুজহাত চৌধুরী।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
ছাত্রশিবির জামায়াতে ইসলামী টপ নিউজ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বিজয় দিবস বিজয় দিবসের কর্মসূচি