অভিযানে কমছে পেঁয়াজের দাম, বেড়ে যাচ্ছে শেষ হলেই
১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩১
রাজশাহী: নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দরে। আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা। এর সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি করছে ৫০ টাকা কেজি দরে। তা সত্ত্বেও রাজশাহীতে পুরনো দেশি পেঁয়াজের ঝাঁঝ কমছে না। কয়েকদিন ধরেই সারাদেশের মতো এই নগরীতেও দেশি পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকা। এ অবস্থায় নগরীতে অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অভিযান চলাকালে দাম কমালেও অভিযান শেষ হতেই ফের পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে চার লাখ ৩২ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন। জেলায় পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ৩২ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন হওয়ায় উদ্বৃত্ত থাকা পেঁয়াজ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে। অথচ গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবারও (১১ ডিসেম্বর) রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা কেজিতে।
এদিকে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পেঁয়াজ বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ডিলাররা জনপ্রতি দুই কেজি করে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ৫০ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন পাঁচটি পয়েন্টে এই পেঁয়াজ বিক্রির কার্যক্রম চলছে।
আরও পড়ুন- হঠাৎ পেঁয়াজ উধাও, দাম দ্বিগুণ— যা করল প্রশাসন
টিসিবির ডিলার মোস্তাক আহমেদ গতকাল সোমবার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরীর সাহেববাজার এলাকায় আজ (গতকাল) দুই হাজার কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছে। টিসিবির পেঁয়াজের চাহিদাও বাড়ছে। এক হাজার মানুষকে এই পেঁয়াজ দেওয়া হয়েছে।’
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে নগরীর সাহেববাজারে অভিযান চালার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী। তিন সবজি ব্যবসায়ীকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি। অভিযানের সময় বেশির ভাগ সবজি বিক্রেতাকে বোডের্র মূল্যতালিকায় পেঁয়াজের কেজি ১৪০ টাকা লিখে রাখতে দেখা যায়। ঘণ্টাখানেক পর অভিযান শেষ হলে আবারও ২০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা যায় তাদের।
সবজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়ত থেকে তাদের পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে বেশি দরে। এরপর কেজিতে ২০ টাকা লাভে তারা পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। এটুকু লাভ না করলে তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন। অথচ যে আড়ত থেকে তাদের বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে, তাদের জরিমানা না করে ভোক্তা অধিকার কেবল খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানা করছে।
সবজি বিক্রেতা ইয়াসিন আলী বলেন, শুধু তারিখ ভুল থাকার কারণে আমাকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে গেছে। আড়তদাররা বলছে, পেঁয়াজ সরবরাহ নেই। তারা বেশি দামে বিক্রি করছে। আমাদেরও বেশি দামে কিনে নিয়ে এসে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকারের অভিযান চলার সময় সাহেববাজারের ব্যবসায়ী শুকুর আলীকে তার দোকানের নিত্যপণ্যের মূল্যতালিকা ঠিক করতে দেখা গেছে। তিনি দাবি করেন, তার পেঁয়াজ কেনা আছে ১৮০ টাকা কেজি দরে। বিক্রি করছেন ২০০ টাকায়। তবে কিছুক্ষণ পরই ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী হাজির হন ব্যবসায়ী শুকুর আলীর দোকানে। জানতে চান, পেঁয়াজ কত টাকা কেজি দরে কিনেছেন। শুকুর আলী জানান, ১৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনেছেন তিনি।
শুকুর আলীও সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার শুধু খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছেই প্রশ্ন করছে। তারা আড়তদারদের কাছে যাচ্ছে না। অথচ আড়তদাররাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এ সমস্যা তৈরি করেছেন।’
নগরীর মাস্টারপাড়ার আড়তে গিয়ে দেখা যায়, আড়তদাররা পুরাতন পেঁয়াজ বিক্রি করছেন না। তারা নতুন পেঁয়াজ ও ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। নতুন দেশি পেঁয়াজের মূল্য লেখা আছে ১১০ টাকা, আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১৩০ টাকা। পুরাতন পেঁয়াজ নেই বলে দাবি আড়তদারদের।
হাসিবুল ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দেশি পেঁয়াজ নেই। তারা ভারত থেকে আমদানি করা ও নতুন বাজারে আসা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছে। আড়তে থাকা একজন বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজের সংকট। আমরা পেঁয়াজ পাচ্ছি না।’ খুচরা বাজারে কীভাবে দেশি পাওয়া যাচ্ছে— এমন প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।
আরেকটি আড়তে গিয়ে ছবি ও ভিডিওধারণকে কেন্দ্র করে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন মালিক আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের জন্য পেঁয়াজের দামের এই অবস্থা। তারা নিউজ না করলে পেঁয়াজের কোনো সমস্যা হবে না।’ এ সময় তিনি সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন।
সবজি ব্যবসায়ীদের জরিমানা শেষে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের রাজশাহীর সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, ‘মূল্য তালিকা না টাঙিয়ে পেঁয়াজ বিক্রির অপরাধে তিন ব্যবসায়ীকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সবাইকে পেঁয়াজের ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য প্রকাশ্যে টাঙিয়ে দিতে বলা হয়েছে। অতিরিক্ত লাভে ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে।’
দাম বৃদ্ধির খবরে অতিরিক্ত পেঁয়াজ না কিনে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু পেঁয়াজই কিনতে ভোক্তাদের পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। বাজার দর স্বাভাবিক রাখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা আফরিন হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা বেশ কিছু বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছি। পেঁয়াজের দাম কমে আসছে। রাজশাহীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজ ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। আশা করা যায়, এই সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম আরও কমে আসবে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা বলেন, ‘পেঁয়াজ উৎপাদনে রাজশাহী জেলা অন্যতম শীর্ষে। চাহিদা মিটিয়ে জেলায় পেঁয়াজ উদ্বৃত্তও থাকে। এ জেলায় পেঁয়াজ সংকট হওয়ার কথা না।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এই কর্মকর্তা জানান, দুই ধরনের পেঁয়াজের মধ্যে এ বছর কন্দ পেঁয়াজ বা মুড়ি কাটা ফুলকার পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে সাত হাজার ৬০৮ হেক্টর জমিতে। সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। কিছুদিনের মধ্যেই এই পেঁয়াজ বাজারে আসবে। অন্যদিকে চারা পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এ বছর এক লাখ তিন হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন। দুই ধরনের পেঁয়াজ মিলিয়ে এ বছর রাজশাহী জেলার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন।
আরও পড়ুন-
- ভারত থেকে দেশে ঢুকল ৭৪৩ টন পেঁয়াজ
- পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে মাঠে গোয়েন্দা পুলিশ
- পেঁয়াজের আড়তসহ চার প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
- বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি, ২ ব্যবসায়ীকে জরিমানা
- বেনাপোলে ‘নষ্ট হচ্ছে’ টিসিবির ৯০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ
- দোকানে লেখা ‘পেঁয়াজ নেই’, আড়তে মিলল ১৭০০ কেজি
- বাজারে আসতে শুরু করেছে মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ
- অনৈতিকভাবে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে: বাণিজ্য সচিব
- পেঁয়াজের দাম বাড়ায় আমদানিকারকদের দুষছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা
সারাবাংলা/টিআর
পেঁয়াজ পেঁয়াজের আড়ত পেঁয়াজের দাম পেঁয়াজের বাজার ভোক্তা অধিকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ভোক্তা অধিকারের অভিযান