৫ম বৈঠকে চূড়ান্ত নাও হতে পারে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি
৩১ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৫৮
ঢাকা: পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের পঞ্চম বৈঠকেও নতুন মজুরি নির্ধারণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে আগামীকালের বৈঠকেই নতুন মজুরি নির্ধারণে শ্রমিক প্রতিনিধির পক্ষে সর্বোচ্চ চাপ থাকবে। দুইপক্ষের আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনের আগেই বাড়বে পোশাক শ্রমিকদের বেতন। সর্বশেষ মজুরি বোর্ডের চতুর্থ বৈঠকে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করার প্রস্তাব দেয় শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি। আর মালিকপক্ষ শ্রমিকদের প্রস্তাবের প্রায় অর্ধেক ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব দেন। তবে ওই বৈঠকে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ হয়নি।
এরইমধ্যে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। আর কোনো কারখানায় কাজের পরিবেশে বিঘ্ন ঘটলে বা সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ওই কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নতুন নূন্যতম মজুরি ঘোষণা করার আহ্বান এসেছে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে।
প্রসঙ্গত, আগামীকাল বুধবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর তোপখানা রোডের নিম্নতম মজুরী বোর্ডের অফিসে বোর্ডের পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকে সংগঠনটি। ওই অনুষ্ঠানে বিজিএমইএ সভাপতি জানান, শ্রমিকদের মজুরি এখনও নির্ধারণ হয়নি। নভেম্বরের মধ্যেই নতুন মজুরি নির্ধারণ হয়ে যাবে। ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হবে।
নেতারা আরও জানান, নতুন কাঠামোতে শ্রমিকরা বেতন পাবেন জানুয়ারি মাসে। একটি পক্ষ ১০ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে এমন তথ্য ছড়িয়ে শ্রম অসন্তোষ সৃষ্টির পায়তারা করছে। শ্রমিকদের আন্দোলনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টাও থাকতে পারে। আন্দোলনে অংশ না নিয়ে শ্রমিকদের ঠিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানান মালিকরা। তবে কোন কারখানায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ওই কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয় বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে।
এমন পরিস্থিতে আগামীকালের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধি বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামীকালের বৈঠকে আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরব। আশা করি ভালো সিদ্ধান্ত আসবে। কালকের মিটিংয়েই যাতে সিদ্ধান্ত আসে, আমাদের সেই চেষ্টা থাকবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা তো প্রথম থেকেই বলে আসছি দ্রুত মজুরি নির্ধারণ করা হোক। যতোটুকু করা যায়, আমরা তাই করবো। শ্রমিকদের দাবি দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া তুলে ধরব।’
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বোর্ডে আলোচনার পর বুঝা যাবে কাল সিদ্ধান্ত আসবে কিনা। মজুরি বোর্ডে এখনও আলোচনা চলেছে। দুই পক্ষই প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু এখনই তো চূড়ান্ত মজুরি নির্ধারণ হয়নি। কিন্তু একটি পক্ষ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে শ্রমিকদের উস্কানি দিচ্ছে। দুষ্টচক্র ও উস্কানিদাতার গার্মেন্টস শিল্পের ইমেজ নষ্ট করছে। এখন ক্রয়াদেশ আসার সময়, ক্রয়াদেশ প্লেসমেন্ট হওয়ার সময়, এই সময় যদি কোন রকম অস্থিরতা তৈরি হয়, অর্ডার কমে যাবে। শ্রমিকদের বলবো, গার্মেন্টস আপনাদের, নিজের সম্পদ নষ্ট করবেন না। ডিসেম্বরে নতুন মজুরি কার্যকর হবে, তার আগে দুই পক্ষের আরও আলোচনার মাধ্যমে নতুন মজুরি নির্ধারণ হবে। সরকার আছে, সরকারও ঠিক করে দেবে। তাই শ্রমিকদের বলবো কর্মস্থলে ফিরে যান। নিজের কর্মস্থল নিরাপদ রাখুন।’
জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামীকাল পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ১১ টায় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। কাল সিদ্ধান্ত আসবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শ্রমিক নেতা জানান, আগামীকাল হয়তো চূড়ান্ত মজুরি নির্ধারণ হবে না, ফাইনাল আরেকটি ডেট দেবে। সেই তারিখে চূড়ান্ত মজুরি নির্ধারণ হতে পারে।
আগামীকালই মজুরি নির্ধারণ হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমাধান তো হবেই। কাল বা নভেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত মজুরি নির্ধারণ হবে।’
তিনি আরও বলেন, মিরপুর ও আশুলিয়ায় আজ যে আক্রমণ হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট দেখা গেছে- বহিরাগতরা ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করে হামলা চালাচ্ছে। চীন থেকে বিনিয়োগ এসেছে, সেই চীনা কোম্পানিতে হামলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কি চীনের বিনিয়োগ আর আসবে? সরকারের উচিৎ ফুটেজ দেখে এদের বিরুদ্ধে একশন নেওয়া। শ্রমিকরা আন্দোলন করছে না। হামলা ও বিক্ষোভ করছে বহিরাগতরা।
পোশাক খাতের এই শীর্ষ নেতা আরও বলেন, ‘মালিকদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৪০০ টাকা, এটি আসলে প্রকৃত বেতন না। সবমিলিয়ে সে কাজে প্রবেশ করলেই ১৩ হাজার টাকার বেশি বেতন পাচ্ছে। এর বাইরে ওভারটাইম রয়েছে। কিন্তু আমরা এই বেতনটি কাকে দিচ্ছে, যে কিছুই জানেনা, একেবারে নতুন, মাত্র কারখানায় প্রবেশ করেছে। বিষয়টি সবার বুঝা উচিত।’
এবার পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে ছয় সদস্যের কমিটির চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা। বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীন।
মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের উপমহাসচিব মকসুদ বেলাল সিদ্দিকী। বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য জাতীয় শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহম্মদ। তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। আর পোশাক শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের প্রতিনিধি জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি।
প্রসঙ্গত, নির্বাচনের আগেই দেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন বাড়বে।
বর্তমানে ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরি পাচ্ছেন তারা। শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এই ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা করার দাবি করা হয়। সংগঠনগুলোর দাবি বেশি হলেও সর্বশেষ মজুরি বোর্ডের চতুর্থ বৈঠকে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করার প্রস্তাব দেয় শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি। আর মালিক পক্ষের প্রতিনিধি শ্রমিকদের প্রস্তাবের প্রায় অর্ধেক ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব দেন। তবে সারাবাংলার কাছে বেশ কয়েকজন মালিকই জানিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকার বেশি দেওয়া সম্ভব না। শ্রমিক ও মালিকপক্ষ যে দাবিই করুক না কেন— শ্রমিকদের মজুরি শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হবে মজুরি বোর্ডে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপও থাকে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, নভেম্বরের মধ্যেই পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্য রয়েছে মজুরি বোর্ডের। সেটি হলে পাঁচ বছর পর আবার পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়তে যাচ্ছে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়ানো হয়েছিল পোশাক শ্রমিকদের বেতন, যা কার্যকর হয়েছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে। এদিকে, বেতন বাড়ানোর দাবিতে এবার শ্রমিক আন্দোলনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে