Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উপসচিবের ‘মামলার ফাঁদ’: স্কুল শিক্ষিকার আগাম জামিন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ২৩:৩৬

ঢাকা: বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিচার চেয়ে এক উপসচিবের (যিনি ২০ বিসিএসের একজন কর্মকর্তা, সর্বশেষ রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন) বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন মুন্সীগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষিকা। এরপর ওই স্কুল শিক্ষিকার বিরুদ্ধে একে একে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি এবং প্রতারণার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সর্বশেষ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় তাকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বিজ্ঞাপন

এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১১ অক্টোবর এ আদেশ দেন। আদেশে চার সপ্তাহের মধ্যে ওই শিক্ষককে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খাইরুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী।

আদেশের বিষয়টি সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) জানান আইনজীবী খাইরুল আলম। তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারী প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হয়রানি করতে ওই নারীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। সর্বশেষ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় হাইকোর্ট ওই নারীকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন। ওই সময়ের মধ্যে তাকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’

এর আগে, চলতি বছরের ৩০ আগস্ট খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার সুজন (৩৮) নামে এক ব্যক্তি উপসচিব সনজয় চক্রবর্তীর বন্ধু পরিচয় দিয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে এজাহার দায়ের করেন।

এজাহারে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ এর ৮(১), ৮(২) এবং ৮(৩) ধারায় ওই স্কুল শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে সনজয় চক্রবর্তীর (৫০) মোবাইল ফোনে বিভিন্ন সময় যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল সংলাপ, অকথ্য, অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা এবং নগ্ন ভাষায় বিরক্ত করার অভিযোগ আনা হয়।

মামলার নথিপত্র, আইনজীবী ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ের প্রলোভনে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিচার চেয়ে ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-০২ ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় মামলা দায়ের করেন।

বিজ্ঞাপন

এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার অভিযোগটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।

পরে ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি পিবিআইর এসআইএন্ডও (অর্গানাইজড ক্রাইম দক্ষিণ) পরিদর্শক ও মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. মেছবাহ উদ্দিন পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এর এক মাস পর ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি পিবিআই থেকে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে দাখিল করা হয়। তবে পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের প্রতি নারাজি আবেদন করেন ওই শিক্ষিকা। আবেদনটি গ্রহণ না করে আদালত একই বছরের মার্চে তা খারিজ করে দেন। এরপর ওই শিক্ষিকা হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল আপিল (ক্রিমিনাল আপিল নং-৪০৭৩/২০২২) দায়ের করেন। পরে ২০২২ সালের ২ নভেম্বর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ক্রিমিনাল আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।

এরপর মামলাটি বেঞ্চ পরিবর্তিত হয়ে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস এবং বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আসে। মামলাটি বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) এই বেঞ্চে শুনানির জন্য কার্য তালিকার ১১২ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।

ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে দায়ের করা পাঁচটি মামলার মধ্যে মুন্সীগঞ্জে প্রতারণার অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি গত ২ অক্টোবর খারিজ করেছেন আদালত। অপর চারটি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।

এর আগে, ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের আদালতে শান্তি নামের এক নারী প্রতারণার অভিযোগ এনে ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এরপর ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় উপসচিব সনজয় চক্রবর্তীর বন্ধু সুজন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন।

এই মামলায় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে তাকে গত ৫ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেফতার করে আদালতে উপস্থাপন করে রিমান্ড আবেদন করলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ভুক্তভোগীর অভিযোগ রিমান্ডে নিয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।
এরপর কয়েক মাস জেল খেটে গত ১৮ জুলাই জামিন পান তিনি। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগী শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত ১০ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার মাসুদ ভূঁইয়ার সইয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালীন ওই শিক্ষিকার প্রাপ্য খোরাকি ভাতাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১০ এপ্রিল এ সংক্রান্ত এক অফিস আদেশে জেলা শিক্ষা অফিসার উল্লেখ করেন, ‘শ্রীনগর উপজেলার গাদিঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ২৪/৩৫ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এ ধারায় থানায় মামলা হয়। মামলা নম্বর ৩৯, তারিখ ১৯ মার্চ ২০২৩। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষিকাকে পুলিশ ৪ এপ্রিল গ্রেফতার করে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ১২ অনুযায়ী গ্রেফতারের তারিখ থেকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’

এর মধ্যে গত ১১ মার্চ ঢাকার চকবাজার থানায় ত্রপা চক্রবর্তী (উপসচিব সনজয় চক্রবর্তীর স্ত্রী) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। যে মামলাটি তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। পরে গত ২০ এপ্রিল রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় আরমানুজ্জামান বাঁধন নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। সেটিও তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।

ওই শিক্ষিকার অভিযোগ, মূলত তাকে কারাগারে আটকে রাখতেই নিজে বাদী না হয়ে অন্য ব্যক্তিকে দিয়ে একটার পর একটা মামলা দিয়ে যাচ্ছে ওই উপসচিব। পাশাপাশি তাকে ও তার পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবীদের নানাভাবে হয়রানি করছেন। যে কারণে তাকে ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

ওই শিক্ষিকা বলেন, ‘২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর উপসচিব সনজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ফেসবুকে আমার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব। একপর্যায়ে আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’

ওই নারী জানান, সনজয় নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে ওই শিক্ষিকাকে বিয়ের আশ্বাস দেন। এভাবেই তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ঢাকার ফকিরাপুলের একটি হোটেল ছাড়াও চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জগামী যাত্রীবাহী লঞ্চের কেবিন ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে যাতায়াত করেছেন। ওই সময়ই সনজয় চক্রবর্তী বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তাকে দফায় দফায় ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ ওই ভুক্তভোগীর।

ওই শিক্ষিকা বলেন, ‘বিয়ের কথা বললে সনজয় এক সময় নিজেকে বিবাহিত বলে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে এক পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় মামলা করতে বাধ্য হই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর আমার শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। উপরন্তু সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালীন আমার প্রাপ্য খোরাকি ভাতা থেকেও আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর পুলিশ এক মামলায় জামিন হলে আরেক মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়েছে। কোনোরকম প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই আমার বিরুদ্ধে একের পর এক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ।’

তিনি বলেন, ‘এখন ন্যায় বিচার পেতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় দায়ের করা মামলায় পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি দিয়েছিলাম। আদালতে তা খারিজ হলে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ক্রিমিনাল আপিল দায়ের করেছি।’

সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম

আগাম জামিন উপসচিব টপ নিউজ মামলার ফাঁদ স্কুলশিক্ষিকা

বিজ্ঞাপন

লন্ডনের পথে খালেদা জিয়া
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩৯

আরো

সম্পর্কিত খবর