শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ রেখে এমপি’র মতবিনিময়!
১৬ অক্টোবর ২০২৩ ২০:০১ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৩৪
সিরাজগঞ্জ: জেলার রায়গঞ্জে একটি ফাজিল মাদরাসার চার শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঁচটি বিষয়ের ক্লাস বন্ধ রেখে প্রতিষ্ঠানটির মাঠে হাজার হাজার সুফলভোগী ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছেন সিরাজগঞ্জ-৩ (তাড়াশ-রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা আংশিক) আসনের সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ। এমনকি সভায় উপস্থিত লোকদের বসানোর জন্য ক্লাসরুমের বেঞ্চও সভায় নিয়ে নেওয়া হয়।
সোমবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ১১টার দিকে উপজেলার নলকা ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ এলাকার মুরাদপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় এই মতবিনিময় সভা শুরু হলেও কার্যক্রম শুরু হয় তারও আগ থেকে। সকাল ৮টার দিক থেকেই সভাস্থলে উপস্থিত হতে থাকেন সুফলভোগীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেন স্থানীয় নলকা ইউনিয়ন পরিষদ। সেখানে এমপি আসেন দুপুর ১২ টার দিকে এবং সভাটি শেষ হয় দুপুর ২টার পরে।
সরেজমিনে এমপি’র মতবিনিময় সভাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার সুফলভোগী ও নেতাকর্মী সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের মাঠে বড় করে একটি মঞ্চ বানানো হয়েছে। সামনে বিশাল সামিয়ানা টানিয়ে সেখানে কয়েক হাজার চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে সুফলভোগী ও নেতাকর্মীদের। মঞ্চে উপস্থিত আছেন নলকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, সলঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক ও রায়গঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ।
অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা দেখা যায়, সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল রায়গঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৃপ্তি কণা মন্ডলেরও। তবে তিনি সভায় উপস্থিত ছিলেন না।
মুরাদপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সকাল ১০টার পরে সভা শুরু হলেও সকাল ৮টা থেকেই লোকজন সভায় আসতে থাকে। অন্যান্য দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আট বিষয়ের ক্লাস হলেও আজ মাদরাসায় এমপি সাহেবের প্রোগ্রাম থাকায় সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিনটি ক্লাস হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়াও প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার পরে ক্লাসরুম থেকে শিক্ষার্থীদের বসার সব বেঞ্চও নিয়ে গেছে তারা। ক্লাসরুমের সামনে সভা হচ্ছে, অনেকগুলো মাইক বাজছে। হাজার হাজার লোক, বেঞ্চও নাই। এভাবে তো আর ক্লাস হয় না।’ তিনি যোগ করেন, ‘আজ ক্লাস হবে না বুঝেই সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ক্লাসের টাইম দেওয়া হয়।’
শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধ রেখে সভার বিষয়ে জানতে চাইলে মুরাদপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা বৃহস্পতিবার একটা মিটিং করে রেজুলেশন করেছি। রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়েছে, এমপি সাহেবের সভার জন্য আজ (১৬ অক্টোবর) মাদরাসায় ক্লাস সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত হবে। রেজুলেশন দেখতে চাইলে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।’
এমনকি মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ক্লাস বন্ধ রেখে এই সভার অনুমতি দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর বেশিকিছু জানার দরকার হলে আপনি সভাপতির সঙ্গে কথা বলুন।’
এ ব্যাপারে মুরাদপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার সভাপতি ও নলকা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কাউসার হোসেন বলেন, ‘যেহেতু আমি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, তাই অধ্যক্ষকে বলেছিলাম আমার বরাবর একটা আবেদন দিতে। এবং মর্নিং শিফটে ক্লাস চালাতে। যেহেতু এত বড় প্রোগ্রাম তাই পাঠদানে একটু সমস্যা তো হবেই।’
মর্নিং শিফটের দুই ঘণ্টায় আটটি ক্লাসের মধ্যে মাত্র তিনটি বিষয়ের ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বসার বেঞ্চ পর্যন্ত বের করে নেওয়া হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সামনাসামনি গিয়ে কথা বলতে বলেন। এ ব্যাপারে সভার আয়োজনকারী নলকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সভার সভাপতি মো. আবু বক্কার সিদ্দিক বলেন, ‘এই মাদরাসা ছাড়া তো প্রোগ্রাম করার জায়গা নাই। জায়গা না পাওয়ার কারণে এখানে সভা করা হয়েছে।’ এ ছাড়াও প্রোগ্রাম শুরুর আগে ক্লাস হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে রায়গঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বন্ধ রেখে সেখানে কোনো সভা সমাবেশ করার নিয়ম নেই। বিষয়টি আমি জানি না, তবে খোঁজ নিয়ে দেখছি।’
সভার বিশেষ অতিথি রায়গঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কালাম আজাদ হৃদয় বলেন, ‘আমার মতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা আগে, সভা-সমাবেশ পরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ রেখে সভা করাটা ঠিক হয়নি।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রায়গঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৃপ্তি কণা মন্ডল’র মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ-৩ (তাড়াশ-রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা আংশিক) আসনের সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ বলেন, ‘সেখানে সকালে শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয়েছে এবং সভার পরেও ক্লাস হবে। এ ছাড়া আমরা ভালো একটা প্রোগ্রাম করেছি। তারা সরকারের সুফল ভোগ করছেন, আমরা তাদের সঙ্গেই মতবিনিময় করেছি। এটা নেতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।’
ওই সময় এমপি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের খাবারও দিয়েছি। তারা এখনো চলে যায়নি, তাদের বাকি ক্লাস হবে। সেখানে তো আর সব ক্লাস বন্ধ ছিল না, কিছু ক্লাস তো হয়েছে। ক্লাস বন্ধ করে সভা হয়েছে এটা সঠিক নয়। সভা তো শুরু হয়েছে দুপুর ১২ টায়, তার আগে অনেক ক্লাস হয়েছে।’
এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বসার বেঞ্চ সভায় এনে বসতে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘প্রোগ্রাম শেষ হওয়া মাত্রই গ্রাম পুলিশদের দিয়ে সেগুলো ক্লাসরুমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সভার বিষয়টি নেগেটিভ করে দেখা ঠিক হচ্ছে না।’
সারাবাংলা/পিটিএম