Friday 10 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশের অর্থনীতি ফোকলা হয়ে গেছে: মির্জা ফখরুল

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৩ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৪০ | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:৫৪

ঢাকা: সরকারের ব্যাংকিংখাতে চরম অব্যবস্থাপনা, লাগামহীন দুর্নীতি, অর্থপাচারে দেশের অর্থনীতি ‘ফোকলা’ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) সকালে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন।

গত ১৫ বছরের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের জানামতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের গতকাল (১২ অক্টোবর) পর্যন্ত ব্যাংকিং ও অন্যান্যখাত থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, একেবারে লুট। বাংলাদেশের অর্থনীতি একেবারে ফোকলা হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে পুরো সম্পদ তারা লুট করে নিয়ে গেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখানে কোনো নতুন বিনিয়োগ নেই, কোনো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। যার ফলে দরিদ্র দরিদ্রই থেকে যাচ্ছে এবং মানুষের আয়ের ফারাকটা, বৈষ্যমটা দিনে দিনে বাড়ছে। এমন একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন একটা পয়েন্ট অব রিটার্নে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে এখানে দুইটা সোসাইটি তৈরি হয়ে গেছে। একটি হচ্ছে খুবই বড় লোক শ্রেণি, যারা বিদেশে যায়, পোশাক-আশাক, দামি গাড়ি বিএমডাব্লিউ, মার্সিডিজ— এগুলো চড়ছে। অন্যদিকে এই গুলশানেই দেখবেন সিগন্যাল পার্টগুলোতে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তারা তাদের প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না। এটিই বাস্তবতা।’

তিনি বলেন, ‘আর্থিক খাতসহ দেশে আইনের শাসন ও সার্বিক শৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জবাবদিহিতা। যেহেতু বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই, সে কারণে তাদের হাতে আমাদের এই দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা— কোনোকিছুই নিরাপদ নয়।’

বিজ্ঞাপন

‘আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহ্বান- আসুন, বাংলাদেশে একটি সত্যিকার জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং দুঃসহ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অবসান ঘটিয়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করি। তাহলেই ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যাংকিং সেক্টর তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করে টেকসই উন্নয়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব’— বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, ‘এই অবৈধ সরকার শুধূ রাজনীতিকে নয়, অর্থনীতিকেও পুরোপুরি ধবংস করেছে। তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে। জনগণ শুধু নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও তারা (সরকার) প্রতারণা করছে। এমন একটি ন্যারেটিভ খাড়া করেছে যে, বাংলাদেশ রোলমডেল হয়ে গেছে যে, থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর ডেভেলপমেন্টের জন্য বারবার এই কথাটা বলতে থাকে, জোর দেয় এবং বিভিন্ন সেতু, উড়াল সেতু, টানেল, মেট্রো রেল উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে এই বিষয়টি বলতে চায় যে, এটি উন্নয়নের দিকে চলে গেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ব্যাংকিংখাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। মূলত সরকারের পলিসিগত বা রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বগ্রাসী লুটপাট আমাদের অর্থনীতির জীবনী শক্তিকে ক্রমেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার সর্বশেষ সংযোজন কেবলমাত্র দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন নামে একটি বিশেষ গ্রুপ তথা ইচ্ছাকৃত লোন ডিফল্টারদের হাতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে জনতা ব্যাংক ২২ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকে। একটি শিল্প গ্রুপ নামে বেনামে অস্তিত্বহীন ভুয়া কোম্পানির নামে কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ গ্রুপটি সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার যোগ্য। এই গ্রুপটি ন্যূনতম এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, “বাংলাদেশের যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুটপাট এখন সবচেয়ে সহজ বলে মন্তব্য করেছেন একজন অর্থনীতিবিদ। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে যারা বিদেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়েছে, একজন অর্থনীতিবিদ তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী।”

তিনি বলেন, ‘সাধারণত কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলে বিদেশি ব্যাংকগুলো সেখানে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছুটে আসে। ২০০৯ সাল থেকে দেশে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৩ টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনো বিদেশি ব্যাংক কি বাংলাদেশে এসেছে? উল্টো যে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারাও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। একই ধরনের প্রোডাক্ট ও সেবা নিয়ে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার প্রতিযোগিতা করছে দেশের ৫২টি ব্যাংক।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসেবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি।’

অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি এখন নজিরবিহীন মন্থরগতিতে চলছে। কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। বিনিয়োগ কমছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। আমদানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি এক মহাচ্যালেঞ্জ। তার ওপর রয়েছে স্বার্থান্বেষীদের সিন্ডিকেট। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকের সঞ্চয়ও শেষ। নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস তো আছেই’— বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, ‘সরকার ও তাদের অবৈধ সুবিধাভোগীরা দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর তথ্যমতে, আমদানি ও রপ্তানি পণ্যমূল্যের মিসইনভয়েসিং এর মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বাংলাদেশ।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এভাবে ৯ বছরেই দেশ থেকে ৭৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। জিএফআই ২০১৫ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের সিআইডি বরাতে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতি বছরে গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর বর্তমানে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই অর্থপাচারের এই বিপুল স্রোত বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেত।’

তিনি বলেন, ‘বিগ থ্রি হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৩টি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে। নেতিবাচক সংকেত দিয়েছে তাতে অর্থনীতি রেড ফ্ল্যাগস এ উঠে এসেছে। গত মে মাসে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি মুডিস বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বিএ ৩ থেকে নামিয়ে বি ১ -এ পুনর্র্নিধারণ করেছে। যেখানে প্রতিটি দেশ ক্রমান্বয়ে ভালো রেটিং পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেখানে গত এক যুগ পর এই ’ন কমানো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের রেটিং আউটলুক হ্রাস করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তারা বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক ঋণমান নির্ধারণ করেছে। সর্বশেষ ফিচ রেটিংসও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নেতিবাচক ঘোষণা করেছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিদেশি ঋণ প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারীরা আর আস্থা রাখতে পারছে না। দেশের এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, অবৈধ সরকারের উন্নয়নের স্লোগানের নিচে চাপা পড়েছিল, যা এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ।’

তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুকাল থেকেই তারল্য সংকটে পড়ে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে ৩ হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও যা ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল। বিশেষ করে শরিয়াহ্ভিত্তিক পরিচালিত পাঁচটি ব্যাংক নিয়মিত সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হয়ে জরিমানায় পড়েছে। এ সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছেন অনেকে। কিন্তু তারল্য সংকটে অনেক ব্যাংক আমানতকারীর নিজস্ব আমানতের এমনকি ১ লাখ টাকার চেকও অনার করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন ও নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম।

সারাবাংলা/এজেড/একে

টপ নিউজ বিএনপি মির্জা ফখরুল

বিজ্ঞাপন

রিয়েলি এবার রিয়েলিই খুশি
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর