শিশুকে তুলে নিয়ে কেটে ৬ টুকরো, আদালতে অভিযোগপত্র
৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:১৩ | আপডেট: ৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৩৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১১ মাস আগে চট্টগ্রামে এক শিশুকে কেটে ছয় টুকরো করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে দেওয়ার লৌমহর্ষক ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রে ওই শিশুকে অপহরণের পর তার দাদার কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করে আবার শিশুটিকে নির্মমভাবে খুন করা তরুণকে আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া তাকে সহযোগিতা করায় এক কিশোরকে অভিযুক্ত করে আলাদাভাবে আদালতে দোষীপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তরুণের বাবা-মা ও বোনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য অভিযোগপত্রে সুপারিশ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক মনোজ কুমার দে।
রোববার (৮ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র ও দোষীপত্র জমা দেন। মামলার ধার্য তারিখে সেগুলো আদালতে দাখিল করা হবে বলে পিবিআই কর্মকর্তা মনোজ জানিয়েছেন।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানার চার বছর ১১ মাস বয়সী মেয়ে আলীনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হন। ঘটনা জেনেই ছায়া তদন্তে নামে পিবিআই।
২৪ নভেম্বর আবির আলী নামে এক তরুণকে আটক করে পিবিআই জানায়, প্রতিবেশি এই তরুণ আয়াতকে অপহরণ করেছিল। এরপর তাকে শ্বাসরোধে খুন করে ১৬ নভেম্বর সকালে লাশের তিনটি টুকরা নগরীর আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে বেড়িবাঁধের পর আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকায় সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ওইদিন রাতে বাকি তিন টুকরা আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে একটি নালায় স্লুইচগেটের প্রবেশমুখে ফেলে দেয় আবির।
আবিরের দেওয়া তথ্যে ৩০ নভেম্বর নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে নালা সংলগ্ন স্লুইচগেট এলাকা থেকে আয়াতের বিচ্ছিন্ন দুই পায়ের অংশ এবং পরদিন খণ্ডিত মাথা উদ্ধার করে পিবিআই।
গ্রেফতার আবির আলী (১৯) নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা আজাহার আলীর ছেলে। তাদের বাড়ি রংপুর জেলায়। আবিরের বাবা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেটির মালিক আয়াতের দাদা মনজুর হোসেন।
এ ঘটনায় ইপিজেড থানায় সোহেল রানার দায়ের করা মামলা প্রায় ১১ মাস তদন্তের পর দাখিল করা অভিযোগপত্রের বিষয়ে পিবিআই পরিদর্শক মনোজ কুমার দে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবির আলী হতাশাগ্রস্ত তরুণ। বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খুঁজে ব্যর্থ হয়। দ্রুত ধনী হওয়ার নেশাও ছিল তার। এজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী সহযোগী এক কিশোরকে নিয়ে আয়াতকে অপহরণ করে।’
‘তিনটি সিএনজি অটোরিকশা কিনে দ্রুত ধনী হওয়ার আশায় আয়াতকে জিম্মি রেখে তার দাদার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেছিল সে। কিন্তু আয়াতকে মুক্ত করে দিলে ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবার ভয়ে তাকে খুন করে।’
পিবিআই জানিয়েছে, খুন ও লাশ গুমের অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২ ও ২০১ ধারায় দাখিল করা আবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে ছয়জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার পর আবিরের বাবা আজাহার আলী, মা আলিমনা আলো এবং তার কিশোরী বোনকেও গ্রেফতার করেছিল। তবে তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে গ্রেফতারের পর আবীর আলীর দেওয়া তথ্যে পিবিআই তার ঘনিষ্ঠ ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে ৬ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেছিল। ওই কিশোর নগরীর ইপিজেড থানার বন্দরটিলা নয়ারহাট এলাকায় আয়াতের বাসার অদূরে ‘ভাই ভাই হোটেলের’ মেসিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিল। একই এলাকার সাইফুল কলোনিতে ব্যাচেলর বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতো।
৭ ডিসেম্বর ওই কিশোর আদালতে জবানবন্দি দিয়ে আয়াতকে অপহরণ ও হত্যার বিষয়ে অবগত থাকার কথা স্বীকার করে। জবানবন্দিতে সে জানায়, মানুষ সন্দেহ করবে- এই ভয়ে আয়াতকে মেরে ফেলার বিষয়টি জানার পরও সে কাউকে কিছু জানায়নি। এরপর থেকে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত সে নিজের মতো করে স্বাভাবিক থাকে।
পিবিআই জানায়, দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় কিশোরকে অভিযুক্ত করে আদালতে পৃথক দোষীপত্র দাখিল করা হয়েছে। কিশোর বয়সী হওয়ায় তার বিচার পৃথক আদালতে চলবে।
জবানবন্দিতে যা বলেছিলেন আবির আলী
আটক আবির আলীকে গত বছরের ২৬ নভেম্বর আয়াত খুনের মামলায় গ্রেফতার দেখায় পিবিআই। দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৩ ডিসেম্বর তিনি আদালতে জবানবন্দি দেন।
আবির জবানবন্দিতে জানায়, ২০ বছর ধরেই আয়াতের দাদা মনজুর আলমের ভাড়া ঘরের নীচতলায় থাকেন আবিরের বাবা আজাহার আলী। ওই ঘরেই জন্ম হয় আবির ও তার বোন আঁখির। শিশু আয়াত আবিরকে চাচ্চু ডাকতো। কিন্তু বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ির পর আবির ও তার বোন মা আলো বেগমের সঙ্গে অন্য বাসায় চলে যায়। তবে তার বাবা থাকত সেই ভাড়া বাসায়।
ঘটনার দিন ১৫ নভেম্বর দুপুরে আবির আলী বাবার বাসায় এসে দেখে- বাবা নেই। আবির আয়াতদের বাসার সামনে অন্যদের সাথে ক্রিকেট খেলতে থাকে। বিকেলে বাসা থেকে মসজিদে কোরআন পড়তে যাওয়ার জন্য দাদার সাথে বের হয় আয়াত। আবির দাদার সামনেই আয়াতকে কোলে নিয়ে আদর করে ছেড়ে দেয়। দাদা সামনে চলে গেলেও আয়াত এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে। তখন আবির তাকে বাবার বাসায় আসতে বলে। কিন্তু আয়াত আসতে চাচ্ছিল না। আবির অভিমান করেছে এমন ভাব দেখালে এগিয়ে আসে আয়াত। আর তখনই তাকে গলা টিপে ধরে বাবা আজহারের ভাড়া ঘরে নিয়ে আসেন। সেখানে গলা টিপে এবং হিজাবের কাপড় মুখে পুরে দিয়ে আয়াতকে খুন করে বাবার ঘরে থাকা একটি বস্তার মধ্যে লাশ ঢুকিয়ে ফেলে।
বিকেল ৪টার দিকে একটি কাপড়ের বস্তা আর আয়াতের লাশের বস্তা নিয়ে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আবির। রিকশায় করে আকমল আলীর মায়ের ভাড়া বাসায়। তখন আবিরের মা আলো বেগম বাসায় ছিলেন। এসব কী জানতে চাইলে আবির বলেন, বা‘বার বাসা থেকে তোমার কথামতো জিনিসপত্র এনেছি।’ আয়াতের লাশভর্তি বস্তাটি কৌশলে সানশেডে রেখে বের হয় আবির, চলে আসে আয়াতদের বাসার সামনে। এর মধ্যে আয়াতকে খোঁজা শুরু হয়।
বাবা সোহেল রানার সঙ্গে আবিরও নিখোঁজ আয়াতের খোঁজ করে জানিয়ে জবানবন্দিতে সে আরও বলে- রাতে বাসায় গিয়ে মা আলো বেগম ও বোনকে আয়াত নিখোঁজ হবার কথা জানায় এবং অনুরোধ করে তারা যেন আয়াতের বাসায় যায়। আলো বেগম মেয়েকে নিয়ে আয়াতদের বাসায় যান। এর মধ্যে দোকান থেকে কচটেপ, ছুরি ও পলিথিন কিনে আনে আবির। সানশেড থেকে আয়াতের লাশ নামিয়ে কাটা শুরু করে। আর তখনই বাসায় ফেরেন মা আলো বেগম ও বোন। কিন্তু আয়াতের শরীর কাটার কাজ তখন শেষদিকে। তাই দরজা না খুলে তাদের ঘরের বাইরে থাকতে অনুরোধ জানিয়ে আবির বলে- সে শরীরের লোম পরিস্কার করছে।
শিশু আয়াতের শরীর ৬ টুকরো করে পলিথিনে ঢুকিয়ে কচটেপ মুড়িয়ে আবারও সানশেডে রেখেই ঘরের দরজা খোলেন। এসময় প্রায় ৩০ মিনিট মা-মেয়েকে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কাটাকাটির শব্দ বাইরে যাতে শোনা না যায় সেজন্য জোরে ফ্যান চালিয়ে দিয়েছিল। বাথরুমে পানির টেপ ছেড়ে রেখেছিল। শরীরের কাটা অংশ সানশেডে রাখার স্থানে আয়াতের শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। রক্তের গন্ধ যাতে না ছড়ার সেজন্য রক্তের ওপর টেলকম পাওডার আর বডি স্প্রে ছিটিয়ে দেয়।
পরদিন সুযোগ বুঝে ব্যাগে করে আয়াতের শরীরের ছয়টি খণ্ড দুই দফায় নগরীর আকমল আলী রোডের শেষ প্রান্তে গিয়ে স্লুইচগেইটে ও আউটার রিং রোডের পর সাগরে ফেলে দিয়ে আসে আবির। ব্যাগে করে লাশের খন্ড নিয়ে বের হবার সময়ও সামনে পড়ে যান মা আলো বেগম। জানতে চাইলে আবির বলে, সে জাহাজের ওয়াচম্যানের চাকরি পেয়েছে, কাজ করতে যাচ্ছে।
দেড়মাস আগে আয়াতকে অপহরণ ও খুনের পরিকল্পনা নিয়েছিল জানিয়ে আবির জবানবন্দিতে বলেন- আয়াতকে ফেরত দেয়ার কথা বলে তার দাদা মনজুর হোসেনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা আদায় করে তিনটি সিএনজি অটোরিকশা কিনে দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য সে এই পরিকল্পনা করেছিল।
সব জেনেও ‘চুপ থাকা’ কিশোরের জবানবন্দি
৭ ডিসেম্বর আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে অভিযুক্ত কিশোর জানায়, বয়স এক-দেড় বছর কম হলেও শৈশব থেকেই আবির তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে তাকে ‘আবির ভাই’ বলে ডাকত। গত অক্টোবর (২০২২) মাসের শুরুর দিকে একদিন ওই এলাকায় নেভি গেটের পাশে নালার প্রতিরোধ দেয়ালের ওপর বসে আড্ডার সময় আবির তাকে জানায়- নয়ারহাট এলাকায় মনজুর বিল্ডিংয়ের (যে বাসায় আবিরের জন্ম এবং মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর তার বাবা এখনও যে বাসায় ভাড়া থাকেন) মালিক মনজুরের নাতনি আয়াতকে অপহরণ করে মেরে ফেলবে আর তার দাদার কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা নেবে।
আবির তাকেও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সঙ্গে থাকার প্রস্তাব দিলেও সে প্রত্যাখান করে। তখন আবির তাকে কাউকে কিছু না বলার নির্দেশ দেয়। তবে ‘পান-সিগারেট না খাওয়া’ আবিরকে ভদ্র-ভালো ছেলে হিসেবে জানতো বিধায় সে তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি।
ঘটনার দিন ১৫ নভেম্বর দুপুরে আবির ও তার এক বন্ধু রবিন ‘ভাই ভাই’ হোটেলে যায়। আবির গরুর গোশত দিয়ে ভাত খায়। রবিন ভাত খায়নি, কিছুক্ষণ হোটেলে বসে চলে যায়। আবির ভাত খেয়ে চলে যায়। বিকেল ৫টার দিকে লোকজনের ছোটাছুটি দেখে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, আয়াতকে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেলে কাজ শেষে বের হওয়ার পর সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে আয়াতের বাসার বিপরীতে এক ভবনের নিচে আবিরের সঙ্গে তার দেখা হয়। দু’জন মিলে ওই এলাকার লেবার কলোনির দিকে আয়াতকে খুঁজতে বের হয়।
‘আমি আবির ভাইকে জিজ্ঞেস করি- আয়াত কোথায়, আপনি কি তাকে কিছু করেছেন? সে জানায়, আয়াতকে অপহরণের পর মেরে ফেলেছে, লাশ আকমল আলী রোডের পকেটগেট এলাকায় তার মায়ের বাসায় রেখেছে। ওই বাসায় মা এবং বোনের সঙ্গে সে থাকতো। আবির ভাই জানায়, দুই-একদিন পর আয়াতের দাদার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করবে। টাকা নেওয়ার সময় আমি থাকলে আমাকেও কিছু টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজি হইনি। আয়াতকে মেরে ফেলার কথা শুনে ভয় পেয়ে বাসায় চলে যাই।’
জবানবন্দিতে ওই কিশোর আরও জানায়, মানুষ সন্দেহ করবে- এই ভয়ে আয়াতকে মেরে ফেলার বিষয়টি জানার পরও সে কাউকে কিছু জানায়নি। এরপর থেকে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত সে নিজের মতো করে স্বাভাবিক থাকে।
জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে ক্ষমা চেয়ে ওই কিশোর বলে, ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি সময়মতো আয়াতকে মেরে ফেলার ঘটনা সবাইকে বলে দিলে টুকরো টুকরো করার আগে লাশটা অন্তত পাওয়া যেত। কিন্তু আমি ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি। পরে আমি শুনেছি- আবির আয়াতের লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে।’
আরও পড়ুন:
শিশুকে ৬ খণ্ড করে সাগরে ভাসাল ‘ক্রাইম পেট্রল’ আসক্ত তরুণ
শিশুকে খুনের পর লাশ ছয় টুকরো: আবির ফের রিমান্ডে
সারাবাংলা/আরডি/ইআ