ফুল নেব না অশ্রু নেব
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৫২ | আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৪
ঢাকা: ‘একটা মালা নেন আপু। একটা মালা কিনেন স্যার। মাত্র ১০টা টাকা। আমার একটা বোন, একটা ভাই মাদ্রাসায় পড়ে। ওদের টাকা দেব স্যার।’
ভরদপুরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল আসমা। সামনে পথচারী যাকেই পাচ্ছিল, তার কাছেই জানাচ্ছিল এমন সকরুণ আবেদন। দুয়েকজন হয়তো তীব্র রোদে দাঁড়ানো আসমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে দয়ার্দ্র হয়ে কিনে নেন ফুলের মালা। কেনেন না বেশির ভাগ পথচারীই। কেউ হয়তো বিরক্ত হয়ে আসমাকে ঠেলে সরিয়ে দেন। তাকে হতাশ হয়ে বসে পড়লে চলে না আসমার। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাকে যে মালা বিক্রি করতেই হবে।
মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর রমনা পার্কে রানির মাঠের কাছে দেখা মিলল আসমার। জানাল, তার দিন শুরু হয় সকাল ৬টায়। রমনা পার্কের মৎস্য ভবন বা চাইনিজ রেস্তোরাঁর গেটে দাঁড়িয়ে বিক্রি করে নয়ন তারা ফুলের মালা কিংবা গোলাপ ফুল। সকাল ৯টার পর পার্কের ভেতরে ঢুকে হেঁটে মালা বিক্রি করে একটানা সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
মা আর তিন ভাই ও দুই বোনের সঙ্গে হাইকোর্ট মাজারেই রাতযাপন আসমাদের। সকালে কিছু খেয়ে, কখনো না খেয়েই সে চলে আসে ফুল বা মালা বিক্রি থেকে তার উপার্জন খুব সামান্যই। সেই উপার্জনের টাকা পুরোটাই তুলে দিতে হয় পরিবারের কাছে। দুপুরের খাবারটাও তাই নিজের টাকায় খাওয়ার সুযোগ নেই তার। তাহলে দুপুরে কী খায় আসমা?
মলিন মুখে জানাল, অনেকেই রমনা পার্কে খাবার নিয়ে আসে। তাদের অনেকেই পুরো খাবার খায় না। তাদের কাছ থেকে পাওয়া উচ্ছিষ্টই আসমার খাবার। কখনো হয়তো কেউ কেউ নিজেদের খাবার থেকেও আসমাকে কিছু খাবার দিয়ে থাকেন। তবে সব দিন সমান যায় না। তাই কোনো কোনোদিন আসমাকে অভুক্তই থাকতে হয়। রাতে মা কিছু রান্না করতে পারলে তা দিয়েই সারাদিনের ক্ষুধা দূর করতে হয় আসমাকে। আর হাইকোর্টের মাজার থেকে যেদিন সিন্নি দেওয়া হয়, সেদিন একটু পেট পুড়ে খাবার সুযোগ পায়।
আসমার বাড়ি নেত্রকোনার লক্ষ্মীগঞ্জের পিচার মাথা গ্রামে। বাবা রব মিয়া মারা গেছেন এক বছর আগে। মায়ের নাম কুসুম। তিন ভাই, তিন বোন তারা। সবাই মিলে মায়ের সঙ্গেই হাইকোর্ট মাজারে থাকে। সেখানে মা ফুলের মালা তৈরি করে দেন, সেগুলোই বিক্রি করতে নিয়ে আসে আসমা।
রমনা পার্কের রানির মাঠের কাছে বসে ডাক দিতেই ছুটে আসে আসমা। বলে, ‘স্যার, মালা নিবেন না ফুল নিবেন? একটা ফুল নেন স্যার, ১০ টাকা দেন। রাতে খাইনি, সকালেও কিছু খাইনি।’
ঘড়ির কাটায় তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। আসমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পাশে এসে দাঁড়ান পার্কের পরিছন্নতাকর্মী সাথী। বললেন, ‘মেয়েটা বড় অসহায়। ওর বাবা নেই। ফুল বিক্রি করে এক বোন ও এক ভাইকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে।’
আসমাকে ১০ টাকা দিয়ে একটি রুটি কিনে খাওয়ার কথা বলতেই সে টাকা নিয়ে চলে গেল রমনা মৎস্য ভবনের গেটের দিকে। সে চলে যাওয়ার আগে তার দিকে তাকাতেই দেখি দুচোখে অশ্রু টলমল করছে। আসমা চলে যেতে যেতেই মনে পড়ছিল কাজী নজরুলের বিখ্যাত গান— ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার/ আঁচল ভরা ফুল/ ফুল নেব না, অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর