Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অসদাচরণের দায়ে আইনজীবীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, সতর্কতায় নোটিশ

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৯:০২ | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩ ২৩:০০

ঢাকা: এক রিট আবেদনে হলফনামা সম্পন্ন না করে রিটটি কার্য তালিকায় এনে শুনানি করানোয় আইনজীবী মো. শফিউর রহমানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ ঘটনায় আদালতের নির্দেশে আইনজীবীদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

লইয়ারস সনদ ইস্যু করে রিট দায়েরের কয়েক সপ্তাহ পরও হলফনামা সম্পন্ন না করায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শফিউর রহমানকে (আইনজীবী সমিতির সদস্য নম্বর: ৪৪৪৬) জরিমানার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্যও সতর্ক করেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

গত ২২ মে বিচারপতি মাহমুদুল হাসান ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সারাবাংলার হাতে এসেছে।

জানা যায়, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখার একটি মামলায় দায়-দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ গ্রহিতার (বরুন সিং রায়) সম্পত্তি নিলামে তুলতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেই নিলামের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ঋণ গ্রহিতা বরুন সিং রায়ের পক্ষে হাইকোর্টে রিট (রিট নং-৩৮২৬/২০২৩) দায়েরের জন্য একটি বেঞ্চ থেকে অনুমতি নেন তার আইনজীবী মো. শফিউর রহমান (আইনজীবী সমিতির সদস্য নম্বর: ৪৪৪৬)।

এরপর হলফনামা শপথ (এফিডেভিট) না করে রিট আবেদনটি শুনানির জন্য জন্য কার্যতালিকায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু রিট আবেদনে হলফনামার জন্য অনুমতি নিলেও পরে তিনি হলফনামা সম্পন্ন না করেই ওই কোর্টের কার্যতালিকায় উঠানোর জন্য রিটটি জমা দেন। পরে যথারীতি রিটটি কার্যতালিতায় আসে। পরবর্তী সময়ে ওই কোর্টে রিটটি চালানো হবে না মর্মে জানিয়ে আদালত থেকে রিটটি তুলে (নট প্রেস) নেন। এভাবে রিট দায়েরের ছয় সপ্তাহ পর আইনজীবী শফিউর রহমান হলফনামায় শপথ সম্পন্ন করেন।

বিজ্ঞাপন

এরপর আরেকটি কোর্টে একই রিট নম্বর দিয়ে মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আনা হয়। তখন বিবাদীপক্ষের আইনজীবী তৌহিদুল হাসান বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। এরপর আদালত এ ধরনের অপেশাদার আচরণের জন্য আইনজীবী শফিউর রহমানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, রিট পিটিশন দায়েরের পর আবেদনকারীর হলফনামায় (এফিডেভিট) শপথ নেওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তাই এ ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফাইলিং সেকশনে এন্ট্রি নম্বর নেওয়ার পর থেকে হলফনামায় (এফিডেভিট সম্পন্ন করার) শপথ নেওয়ার জন্য একটি সময়সীমা থাকা উচিত।

রায়ে আদালত নির্দেশ দেন, ফাইলিং সেকশন থেকে এন্টি নম্বর নেওয়ার পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে অবশ্যই হলফনামায় (এফিডেভিট সম্পন্ন করতে হবে) শপথ নিতে হবে। একই সঙ্গে ফাইলিং সেকশনে এই সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে হলফনামায় শপথ গ্রহণের জন্য আর কোনো আবেদন গ্রহণ না করার জন্য হলফনামা কমিশনারের প্রতি (এফিডেভিট কমিশনার) নির্দেশ দেওয়া হয়।

রায়ে আদালত বলেন, হলফনামায় শপথ নেওয়ার আগে, আদালতের সামনে বিষয়টিকে In Re (In Re বা মোশন মামলা) হিসাবে উল্লেখ করা বিজ্ঞ আইনজীবীর পক্ষ থেকে একটি প্রতারণামূলক অনুশীলন। এ জন্য আবেদনকারীকে অবমূল্যায়িত করা আবশ্যক। যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিট পিটিশন দাখিল না করে, এভাবে লইয়ারস সার্টিফিকেট প্রদান করা বিজ্ঞ আইনজীবীর একটা পরিপূর্ণ অপেশাদার আচরণ।

উচ্চ আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীর এ ধরনের কাজ ও আচরণ অবাঞ্ছিত এবং অযৌক্তিক। বিজ্ঞ আইনজীবীর এই কাজ আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, বিশেষ করে অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। যা কোনোভাবেই ক্ষমা করা যায় না।

আদালত বলেন, এই আদালত সদয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে বিজ্ঞ আইনজীবী মো. শফিউর রহমানকে সতর্ক করছে যে, ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে না। ভবিষ্যতে এই ধরনের পেশাগত অসদাচরণ খুঁজে পেলে তার আইনজীবী সনদ বাতিলের জন্য বার কাউন্সিলের কাছে পাঠানো হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের যে কোনো আদালতে আইন অনুশীলন করার ক্ষেত্রে বাধা/নিষেধ দেওয়া হবে। যাই হোক, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বিজ্ঞ আইনজীবী শফিউর রহমানকে তার নিজের পকেট থেকে জরিমানা দিতে হবে।

সে জন্য বিজ্ঞ ফাইলিং লইয়ার মো. শফিকুর রহমানকে (আইনজীবী সমিতির সদস্য আইডি নং ৪৪৪৬) ৫০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হলো। এই টাকা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অফিসার এবং কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে পেইয়ী চেকের (Payee Cheque) মাধ্যমে সাত দিনের মধ্যে প্রদান করতে হবে।

রায়ে ফাইলিং সেকশনে রিট পিটিশন দায়ের করা এবং হলফনামায় শপথ গ্রহণ সম্পন্ন করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারকে অফিস আদেশ জারির নির্দেশ দেন। এবং বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলেন আদালত।

এরপর উক্ত রায়ের নির্দেশনা অনুসারে গত ৪ জুলাই অফিস আদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

ডেপুটি রেজিস্ট্রার এ, এইচ এম তোয়াহার সই করা সেই অফিস আদেশের ভাষ্য হলো, ‘‘রিট পিটিশন নং-৩৮২৬/২০২৩ এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মাহমুদুল হক এবং বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কর্তৃক গত ২২ মে তারিখে ৩৮২৬/২০২৩ রিট পিটিশনে আদেশ প্রদান করেছেন।

এতে বলা হয়, ফাইলিং সেকশন থেকে এন্টি নেওয়ার পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে অবশ্যই হলফনামায় (এফিডেভিট সম্পন্ন করতে হবে) শপথ নিতে হবে। একই সঙ্গে ফাইলিং সেকশনে এই সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে হলফনামায় শপথ গ্রহণের জন্য আর কোনো আবেদন গ্রহণ না করার জন্য হলফনামা কমিশনারের প্রতি (এফিডেভিট কমিশনার) নির্দেশ দেওয়া হয়।

ফাইলিং সেকশনে রিট পিটিশন দায়ের করা এবং হলফনামায় শপথ গ্রহণ সম্পন্ন করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশনা/অফিস আদেশ জারির নির্দেশ দেন। এবং এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

উক্ত রিট পিটিশনে আদালতের আদেশের নির্দেশানাসমূহ যথাযথভাবে পালনের জন্য অনুরোধ করা হলো।’’

এদিকে রায় প্রকাশের নির্ধারিত সাত দিনের মধ্যে আইনজীবী শফিউর রহমান জরিমানার ৫০ হাজার টাকা সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট্রের অনুকুলে টাকা জমা দিয়েছেন। বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট্রের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আজিম উদ্দিন (প্রশাসনিক কর্মকর্তা)।

মামলার বিবরণে জানা যায়, চট্টগ্রামের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে জমি বন্ধক (মর্গেজ) রেখে বরুন সিং রায় নামের এক ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেন। এরপর ব্যাংকের পাওনা বাবদ ৮৮ লাখ ৭৬ হাজার ৩৩৫ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বরুন সিংয়ের জমি নিলামে উঠানোর জন্য চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত থেকে রায় নিজেদের পক্ষে পায় ডাচ বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বরুন সিংয়ের জমি নিলামে তুলতে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় গত ১৬ মার্চ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এরপর ওই নিলাম বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়েরের সিদ্ধান্ত নেন বরুন সিং রায়। নিলাম স্থগিত চেয়ে রিট দায়েরের জন্য বিচারপতি জেবিএম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে গত ১৬ মার্চ অনুমতি নেওয়া হয়। এর সাতদিন পর গত ২৩ মার্চ সংশ্লিষ্ট ফাইলিং সেকশনে বরুন সিং রায়ের আইনজীবী শফিউর রহমান রিটটি দায়ের করেন। এরপর আইনজীবী শফিউর রহমান ফাইলিং সেকশন থেকে এন্ট্রির সুবিধা গ্রহণ করে এবং এটি রিট পিটিশন নং-৩৮২৬/২০২৩ হিসেবে নথিভুক্ত করান। পাশাপাশি রিট আবেদনটি কার্যতালিকায়ও আনা হয়। এরপর রিটটি না চালানোর কথা বলে সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে নট প্রেস করান এই আইনজীবী। পরবর্তীতে রিট দায়ের করার ছয় সপ্তাহ পর গত ১০ মে রিটের হলফনামাটি সম্পন্ন করেন তিনি।

এরপর অপর একটি বেঞ্চে রিটটি শুনানির জন্য আবেদন করা হয়। এবং যথারীতি রিট আবেদনটি কার্যতালিকায় নিয়ে আসা হয়।

রিটটি শুনানিকালে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী তৌহিদুল হাসান আদালতকে জানান, গত ২৩ মার্চ আইনজীবী শফিউর রহমান রিট দায়ের করলেও গত ১০ মে হলফনামা সম্পন্ন করা হয়েছে এবং এই সময়ে আইনজীবী শফিউর রহমান রিটের হলফনামা সম্পন্ন না করেই অন্য একটি বেঞ্চ থেকে রিটটি নট প্রেস করিয়েছেন। তখন আদালতও বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পায়। এরপর আদালত আইনজীবী শফিউর রহমানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

সারাবাংলা/কেআইএফ/একে

জরিমানা টপ নিউজ হাইকোর্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর