সম্পত্তির লোভে মনজিল হত্যা, ৬ বছরেও শেষ হয়নি বিচার
৪ জুলাই ২০২৩ ১৭:০৯ | আপডেট: ৪ জুলাই ২০২৩ ১৭:২০
ঢাকা: ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার আফতাবনগরে নিজ ফ্ল্যাটে হত্যার শিকার হন ও লেভেল পড়ুয়া মনজিল হক। হত্যাকাণ্ডের পর তার চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে একটি মামলা করেন। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে উঠে আসে মনজিলের সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, সৎ মামা আবু ইউসুফ নয়ন ও সৎ ভাই এ কে এম ইয়াসিন হক ও মামলার বাদী চাচা ফারুক মিয়া ওই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা। সম্পত্তির লোভেই মনজিলকে হত্যা করা হয়।
হত্যার ঘটনার ৬ বছর পার হলেও মামলার বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। কবে নাগাদ বিচার শেষ হতে পারে তাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছেন, খুব শিগগিরই মামলার বিচারকাজ শেষ হবে।
বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক নজরুল ইসলামের আদালতে এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়েছে। মামলার চার্জশিটের ৪২ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী নিহতের বান্ধবী শারমিন আক্তার নিশীও সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ১৩ জুলাই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী পাবলিকপ্রসিকিউটর আজাদ রহমান জানান, এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটির বিচারকার্য দ্রুত শেষ করার জন্য চেষ্টা করছি। এ জন্য প্রতি সপ্তাহে একটা করে তারিখ ধার্য করেন আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী অভিযোগ করে বলেন, ‘আসামিরা প্রতিনিয়ত সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এরইমধ্যে এক আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এ জন্য সাক্ষীরাও ঠিকমত আদালতে আসছেন না। মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুইজন সাক্ষীর মধ্যে এখনও একজনের বাকি রয়েছে। সেই সাক্ষী বাড়ির দারোয়ান হওয়ায় চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। দারোয়ানের জবানবন্দি গ্রহণ হলে আরও পরিষ্কার হওয়া যাবে ঠিক কী কারণে মনজিলকে খুন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমরা আশা করছি খুব দ্রুত বিচার শেষ হবে এবং ভিকটিম ন্যায় বিচার পাবেন।’
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ছোট্ট বয়সে মাকে হারান এ কে এম মনজিল হক। এরপর বেড়ে ওঠেন সৎ মায়ের কাছে। ৩০ বছর বয়সে বাবাও মারা যান। ধন-সম্পদ নিয়ে শুরু হয় চাচা, সৎ মা, ভাই ও মামার সঙ্গে মনোমালিন্য। আলাদা হয়ে মনজিল অন্য জায়গায় বসবাস শুরু করেন। নিঃসঙ্গ জীবনে শারমিন আক্তারের সঙ্গে মনজিলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবেই কাটছিল মনজিলের জীবন। কিন্তু সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে চাচা, সৎ মা, সৎ ভাই ভাই ও সৎ মামা উঠেপড়ে লাগে।
ভিকটিম মনজিলকে হত্যার করার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ইয়াসিন হক ও ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব, সীমান্ত হাসান তাকবীর। এ ছাড়া সাক্ষী হিসেবে নিহতের বান্ধবী শারমিন আক্তার নিশী ও যে বাড়িতে খুন হন সে বাড়ির তৎকালীন দারোয়ান মো. আবুল কালামও সাক্ষ্য দেন। তাতেই উঠে এসেছে কীভাবে মনজিলকে হত্যা করা হয়।
২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর মামলাটির তদন্ত করে এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর মো. শামসুদ্দিন। মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, মনজিলের সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, সৎ মামা আবু ইউসুফ নয়ন, সৎ ভাই একেএম ইয়াসিন হক, মামলার বাদী চাচা ফারুক মিয়া, রবিউল ইসলাম সিয়াম ও আবু ইউসুফ নয়ন।
মাহফুজুল ইসলাম অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার বিচার শিশু আদালতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইয়াসিনসহ স্বীকারোক্তিকারীরা বর্তমানে কারাগারে আছেন। তার মা লায়লা, মামা আবু ইউসুফ নয়ন ও চাচা ফারুক মিয়া এই মামলায় পলাতক রয়েছেন।
মামলার চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ১৯৯২ সালে মনজিল হকের মা ঢাকার শান্তিনগর এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে বসবাস করাকালে কাপড়-চোপড়ে আগুন ধরে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় মারা যান। তখন মনজিলের বয়স ছিল ৩/৪ বছর। মনজিলের মায়ের মৃত্যুর পর বাবা এ কে এম মঈনুল হক ওরফে মনা খালাতো শ্যালিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে বিয়ে করেন। তার এ সংসারে এ কে এম ইয়াসিন হক ও তিন মেয়ে জন্মগ্রহণ করে।
২০১৭ সালের ২০ মে মঈনুল হক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার আগে বনশ্রী এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেন। সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। আফতাব নগরে ৪৭ লাখ টাকা দিয়ে আরও একটি ফ্ল্যাট কিনেন তিনি। যার মধ্যে ২৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন এবং ২২ লাখ টাকা কিস্তিতে পরিশোধের জন্য ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তিও করেছিলেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি ও ও সৎ ভাই একেএম ইয়াসিন হকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় দুই মাস পর মনজিল আফতাব নগরের ফ্ল্যাটে ওঠেন। বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার নিশার সঙ্গে মনজিলের প্রেমের সম্পর্ক হয়। ঘটনার এক মাস আগে ইয়াসিন তার ছোট মামা আবু ইউসুফ নয়নের সাথে মনজিলকে খুন করার বিষয়ে পরামর্শ করেন। আবু ইউসুফ এতে সম্মতি দেন এবং তাকে ২০ হাজার টাকাও দেন। ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকৃত নগদ ৩৭ লাখ টাকা ছাড়াও মনজিলের বাবা গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনা এলাকায়ও সম্পত্তি রেখে যান। মনজিলের মৃত্যুর আগে ফ্ল্যাট দুটিসহ অন্যান্য সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ভাই ইয়াসিনের সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয়। ইয়াসিন সব সম্পত্তি ভোগ দখল করতে পেশাদার ভাড়াটে খুনিদের সহযোগিতায় তার মা লায়লা ইয়াসমিন ও মামা আবু ইউসুফের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় এবং মামলার বাদী ফারুক মিয়ার সহযোগিতায় মনজিলের ফ্ল্যাটে তাকে খুন করে।
এর আগে ইয়াসিনের বাসায় বসে মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সেখানে ইয়াসিনের মা, মামা ও চাচা উপস্থিত ছিল। এদিকে মনজিলকে হত্যা করলে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর সকালে তারা মনজিলের ফ্ল্যাটের সামনে চায়ের দোকানো অপেক্ষা করতে থাকে। মনজিলের সৎ ভাই ইয়াসিন তার সহযোগীদের বসিয়ে রেখে মনজিলের বাসার সামনে যায় এবং কাজের বুয়া চলে গেছে কি না খোঁজ নেয়। সে মনজিলের ঘরের সামনে এক জোড়া স্যান্ডেল দেখতে পায়। ইয়াসিন বুঝতে পারে কাজের বুয়া আছে। সকাল ১১টার দিকে তারা বাসায় ঢুকতে গেলে দারোয়ান ইয়াসিনকে বাধা দেয়। তখন ইয়াসিন বলে, সে মনজিলের ভাই। একপর্যায়ে সবাই মনজিলের ফ্ল্যাটে যায়।
ইয়াসিন মনজিলকে উদ্দেশ্যে করে বলে, এরা তার বন্ধু। তাদের একটি মোটরসাইকেল পুলিশ আটকিয়েছে। মনজিল থানায় ফোন দিলেই মোটরসাইকেলটি ছেড়ে দেবে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসিন মনজিলকে জাপটে ধরে। তখন সিয়াম তার গলায় থাকা মাফলার দিয়ে মনজিলের মুখ বাঁধে। তখন রাকিবও মাফলার দিয়ে মনজিলের মুখ চেপে ধরেন।
কিলিং মিশনে থাকা তাকবীর মনজিলের পা ধরে। সিয়াম ব্যাগ থেকে রশি বের করে মনজিলের পা বাঁধতে যায়। মনজিল লাথি মারলে সিয়াম পড়ে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকবীর তাকবীর সিয়ামকে বলে,‘সিয়াম ভাই, অ্যাকশনে যাও।’
সিয়াম তখন তাকবীরের পকেটে থাকা চাকু দিয়ে মনজিলের পেটে জোরে আঘাত করে। এতে পেট থেকে রক্ত পড়তে থাকে এবং পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায়। ইয়াসিন চাকু দিয়ে মনজিলের গলা কাটে, দুই হাতের রগ কাটে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বুকের বামপাশে হৃদপিণ্ড বরারবর চাকু দিয়ে জোরে খোঁচা মারে।
এ সময় মনজিলের ফ্ল্যাটে আসেন শারমিন। সে কলিং বেল টিপতে থাকে। অনবরত মনজিলের ফোনে ফোন দিতে থাকে। তখন তাকবিরকে ফোন রিসিভ করে বলে, ভাই অসুস্থ। আপনি এক ঘণ্টা পরে আসুন। শারমিন সেখান থেকে না গিয়ে আশেপাশের সিঁড়িতে ঘোরাঘুরি করে। পরে খুনিরা রক্তমাখা কাপড় পরিবর্তন করে বেরিয়ে যায়। সিড়ি দিয়ে নামার সময় শারমিন ও দারোয়ান আবুল কালাম খুনিদের দেখেন। এ সময় মনজিলের সৎ ভাই ইয়াসিনকে দেখেও তারা চিনতে পারেন।
এদিকে মামলার বাদী ফারুক ও নিহত মনজিলের বাবা আপন বড় ভাই। তারা একই সঙ্গে গার্মেন্টসের ব্যবসা করতেন। শান্তিনগর বাজারের পেছনে মনজিল এবং ইয়াসিন ও ফারুকের ছেলের নামে একটি যৌথ ফ্ল্যাট ছিল। পরে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি নিয়ে ফারুক তার ভাই মনার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ায়। এ নিয়েও মনজিলের ওপর ক্ষোভও ছিল চাচা ফারুকের। ওই ক্ষোভ থেকেই মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনায় ভাতিজা ইয়াসিনের সঙ্গে চাচা ফারুকও যোগ দেয়।
সারাবাংলা/এআই/একে