‘আমেরিকার ভিসানীতি এমন যে, দিনের ভোট রাতে করলে রেহাই নেই’
১৪ জুন ২০২৩ ২০:৫০ | আপডেট: ১৪ জুন ২০২৩ ২২:২২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আমেরিকার ভিসানীতির কারণে এবার ‘দিনের ভোট রাতে’ করলে রেহাই মিলবে না বলে সরকারকে হুঁশিয়ার করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার (১৪ জুন) বিকেলে নগরীর কাজীর দেউড়ি মোড়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বিভাগীয় ‘তারুণ্যের সমাবেশে’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমেরিকার ভিসানীতি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলছে তারা ভয় পায় না। তবে তারা ভয় পাচ্ছে । এমন ভয় পাচ্ছে যে হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কারণ, তারা তো সবাই থাকে বিদেশে। ওখানেই তাদের টাকা পাচার করেছে। ভিসানীতি এমন হয়েছে, এবার যদি তোমরা দিনের ভোট রাতে কর, চুরি মার্কা নির্বাচন কর তাহলে এবার রেহাই নেই।’
আওয়ামী লীগ জনগণের টাকা দিয়ে নিজেদের উন্নয়ন করেছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশের সমস্ত সম্পদ লুট করে আওয়ামী লীগ বিদেশে পাচার করেছে। তারা বিদ্যুৎ দিতে পারে না। এখানে আসার সময় দেখলাম বিদ্যুৎ নেই। আপনারা টাকা তো ঠিকই নিচ্ছেন। একবার, দুই বার, তিন বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সব টাকা নিয়েছেন। তাহলে সে টাকা কোথায়? বিদ্যুতের দাম দেওয়ার সময় এক হাজার টাকা দিলে তিনশ টাকা নেই। এসব উন্নয়ন শেখ হাসিনা করছে। এগুলো কীসের উন্নয়ন, কার উন্নয়ন? জনগণের টাকা দিয়ে নিজেদের উন্নয়ন করছে তারা। মেগাপ্রকল্পের নাম দিয়ে জনগণের টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। মানুষের ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। সেই বাংলাদেশকে আজ রক্ষা করতে তরুণ-যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে। এই সরকার ক্ষমতায় বসে আছে জোর করে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে, ভাওতাবাজি করে পর পর দু’টি নির্বাচনে চুরি করে। পুলিশ কিংবা প্রশাসন সবাইকে হাতে রেখে তারা ক্ষমতায় বসে আছে।’
‘১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা, এখন যিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে আছেন, তিনি মাথায় হিজাব পরে, হাতে তসবি নিয়ে সবার কাছে মাফ চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। কই চাকরি? দেশের তরুণ ছেলেদের চাকরি হচ্ছে? করুণ অবস্থায় আছে আমাদের যুবক ও তরুণেরা। তাদের সামনে অন্ধকার। তারা বুঝতে পারছে না কীভাবে ভবিষ্যতে তারা জীবন চালাবে। কীভাবে পরিবারকে তারা সাহায্য করবে।’
ফখরুল আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষ, শ্রমিক ও কৃষক ভাইরা বাজারে যেতে পারে না। বাজারে আগুন। চালের দাম, তেলের দাম বেড়ে গেছে। সবজির দাম, চিনির দাম, লবণের দাম বেড়েছে। ডিম, মুরগির দামও বেড়ে গেছে। তারা বলে বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। কারণ, তারা ভালো আছে। দেশের মানুষের কষ্টে উপার্জিত লাখ লাখ কোটি টাকা চুরি করে সব টাকা বাইরে পাচার করে দিয়েছে। শুধু টাকা নয়, তাদের সন্তানদেরও পাঠিয়ে দিচ্ছে।’
গুম-খুন, নির্যাতনের অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো মতে দিনযাপন করছে। ১৫ বছর ধরে এই নির্যাতন চলছে। তারা খুন করেছে, গুম করেছে, আমাদের নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে। আমাদের সমস্ত গণতান্ত্রিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে প্রতিদিন হয়রানি করছে। আমাদের নেতা আসলাম চৌধুরীসহ অনেক নেতা জেলে আছে।’
‘সারা বাংলাদেশে বিএনপির ৬০০ নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। সিলেটের সাবেক এমপি যুবনেতা ইলিয়াছ আলীর খোঁজ গত ১৩ বছর ধরে নেই। তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তার ছেলে বড় হয়েছে, ব্যারিস্টার হয়েছে, ছোট মেয়ে তার তখন ছয় বছর ছিল, তার বয়স এখন ১৮ বছর। বাড়ির দরজার দিকে এখনো সে চেয়ে দেখে কখন তার বাবা ফিরবে। ছোট মেয়ে সাফা, তার বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন সে তার মেয়ের গর্ভে ছিল। এখন সে যখন সাংবাদিকদের সামনে আসে তখন সে বলে, আমি আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কোথাও শান্তি নেই। প্রতি পদে পদে আমাদের গলা টিপে ধরা হয়েছে। এই দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? এই দেশ কি যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে তারা চেয়েছিল? আমরা চেয়েছিলাম একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যেখানে আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। আমরা কথা বলতে পারব, আমরা লিখতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকরা এখন লিখতে পারেন না। কারণ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে তলোয়ার চালানো হচ্ছে। যেটা সবার মাথার উপর পড়বে। গুম হয়ে যাবে, কারাগারে যেতে হবে। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, সামসুজ্জামান তাদের আবার কারাগারে যেতে হয়েছে। ফটোগ্রাফার শহীদুল ইসলামকে তুলে নিয়ে গিয়ে সাত মাস কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছে। দুই সাংবাদিক দম্পতিকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। এখনো সেই খুনিদের হদিস মিলল না। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছে, এদেশে নাকি গণতন্ত্র আছে। এদেশে সবচেয়ে ভালো ভোট হয়। মানুষের অধিকার আছে। তার নমুনা আমরা দেখছি।’
জনগণকে বিএনপি ক্ষমতায় নিয়ে যেতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৪ বছর ধরে আমাদের মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। কোর্টে গেলে আমাদের ভয় দেখানো হয়, বিচার হয় না। আমরা হাইকোর্টে গিয়ে আগাম জামিন নিলে নিম্ন আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পুলিশ, বিডিআর, র্যাব, রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে উনারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই না, আমরা জনগণকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে চাই। আমরা ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। এখানে যেসব তরুণ ভাইরা এসেছে তারা তো শুধু বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে লড়াই করছে না। তারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, ভোটের অধিকার ও চাকরি পাওয়ার জন্য লড়াই করছে।’
উন্নয়নের নামে লুটপাট হচ্ছে অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, ‘চট্টগ্রামে লাখ কোটি টাকা খরচ করে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। টানেল আমাদের প্রয়োজন। তবে আগে আমাদের বাঁচা দরকার। চিকিৎসা দরকার, খাবার দরকার, চাকরি দরকার। দেশে কলকারখানা কোথায়? যা ছিল তাও কমে যাচ্ছে। গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমদানি করা যাচ্ছে না। কেনো? কারণ ডলার নেই। শুধু ভোট চুরি নয়, তারা আমার সম্পদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকও চুরি করে নিয়ে গেছে। এইরকম লুটেরা, চোর আর একদিন ক্ষমতায় থাকলে সেটা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।’
তিনি বলেন, ‘বরিশালে মেয়র নির্বাচনের ভোটে যখন তারা দেখল হেরে যাবে তখন ইভিএমে কারসাজি করে ভোট চুরি করল। শুধু তাই না, চরমোনাই পীর একজন আলেম মানুষ, তাকে সবাই শ্রদ্ধা করে। তাকে মেরে রক্ত বের করে দিয়েছে। গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের মায়ের কাছে হেরেছে। যে দেশে ৪০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয় সে দেশে গণতন্ত্র থাকতে পারে না। এটা কোনো দেশ হলো? ইস্পাত কঠিন ঐক্য নিয়ে আমাদের এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।’
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। তাদের কোনো জনসমর্থন নেই, তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের নির্ভরশীলতা কোথায়? তাদের নির্ভরশীলতা পুলিশের কিছু অংশ, কিছু বিজিবি, র্যাব এদের কাছে। তবে সবার কাছে না। তাদের নির্ভরশীলতায় এখানে। কারণ তাদের সঙ্গে কেউ নেই। দেশেও নেই, বিদেশেও নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্ভরশীলতা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ। সবাই রাস্তায় নেমেছে। তারুণ্যর শক্তি রাস্তায় নেমেছে। ইংরেজিতে বলে গেইম ওভার। আর বাংলাতে বলে খেলা শেষ। ওরা তো বলে খেলা হবে। আমি বলব খেলা শেষ। আপনাদের স্কোর জিরো।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আজ খুব অসহায়। তাদের অসহায়ত্ব দেখে আমার খুব দুঃখ হয়। সহজ উপায় নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর এখানে কোনো উপায় নেই। খালেদা জিয়ার মুক্তি আমরা চাচ্ছি না। আমরা তাকে মুক্ত করব। তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনব। কোটি কোটি জনতা তাকে সেদিন আমন্ত্রণ জানাবে, স্বাগত জানাবে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ববাদী সরকার। চলমান আন্দোলনে আমাদের এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি। বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।’
কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসানের যৌথ সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহাজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন, সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশীদ এবং কেন্দ্রীয় সদস্য মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন।
এছাড়া কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, নগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তী ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এইচ এম রাশেদ খান ও সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বুলু, নগর ছাত্রদলের আহবায়ক সাইফুল আলম ও সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিন সমাবেশে বক্তৃতা করেন।
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম