‘নির্বাচনি নয়, আসছে বাস্তবভিত্তিক বাজেট’
২৮ মে ২০২৩ ০৮:১৮ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৩ ০৮:১৯
এক বছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাবই হচ্ছে একটি দেশের বাজেট। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সেই বাজেটেই রয়েছে যত সংকট। একদিকে বৈরী আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, অপর দিকে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়নে থাকছে ঝুঁকি। অর্থাৎ বর্তমান সরকার বাজেটটি তৈরির করলেও এর একটি অংশ বাস্তবায়ন করবে চলতি সরকার, মাঝের একটি অংশ নির্বাচনকালীন সরকার এবং শেষ অংশ বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী সরকার। তাই নতুন বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে নানান দিক নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। একদিকে জনতুষ্টি, আরেক দিকে বাস্তবতা। কোন দিকটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবারের বাজেটে। এ রকম নানান বিষয় নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সম্প্রতি সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জোসনা জামান।
সারাবাংলা: আসন্ন বাজেট কেমন হচ্ছে?
এম এ মান্নান: আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নির্বাচনি নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক হবে। কেননা আমরা যে উন্নয়নের পথে আছি, উড়ন্ত পর্যায়ে আছি, সেটিকে এগিয়ে নিতে হবে। যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে হোঁচট খেয়েছিলাম। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সেটি এখনও চলছে। ফলে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। সেখানে আমাদের কোনো হাত না থাকলেও আমরা সেই অনিশ্চয়তার শিকার হচ্ছি। এসব কারণে উচ্চাভিলাসী বাজেট তৈরির সুযোগ নেই।
সারাবাংলা: বাজেট তৈরিতে বিশেষ গুরুত্বের দিক কোনটি?
এম এ মান্নান: রফতানি বহুমুখীকরণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা আমাদের রফতানি বাণিজ্য শুধু পোশাক খাতনির্ভর; এই খাতে আমাদের অর্জন অনেক বেশি। কিন্তু সেই অর্জনেরওতো একটা সীমা আছে। যখন সেখানে পৌঁছানো শেষ হবে, তখন আমাদের অর্থনীতির কি হবে? এজন্য রফতানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ করতে হবে। আমরা সেই কাজ করছি। যাতে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ হয় সেই বিষয়টিকে বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
সারাবাংলা: নির্বাচন সামনে রেখে ভোটার সন্তুষ্টিতে নজর রাখছেন কিনা?
এম এ মান্নান: সরকার যেসব কাজ করে সবই জনগণের জন্য করে। আমাদের সরকার গণতান্ত্রিক ও জনগণের সরকার। তাই যাই করা হোক না কেন সবই জনতুষ্টির উদ্দেশ্যেই। তবে মানুষের মধ্যে যাতে স্বস্তি ফিরে আসে, সাধারণ মানুষ যাতে উন্নয়নের সমান অংশীদার হতে পারে- সেসব বিষয়ে নজর দিয়ে বাজেট তৈরি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, যারা ভোটার তার তো এদেশের জনগণ। জনগণের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব সরকারের। সেই দৃষ্টিতে দেখলে বাজেটে জনগণকে তুষ্ট করার উপাদান থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর পেছনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উদ্দেশ্য থাকবে না।
সারাবাংলা: বাজেটে ভর্তুকির বিষয়ে কিছু বলুন।
এম এ মান্নান: আমাদের উপর ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ আছে। ডিজেলে ভর্তুকি কমানো হবে না। অন্যান্য যেসব খাতের এখন ভর্তুকি বিদ্যমান সেগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই আগামী বাজেটে ভর্তুকি কমে যেতে পারে।
সারাবাংলা: বাজেটে কৃচ্ছ্র সাধনের প্রভাব কেমন?
এম এ মান্নান: কৃচ্ছ্র সাধন এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংকটের শুরু থেকেই এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে আসছেন। সর্বশেষ গত ১১ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকেও তিনি বলেছেন, অহেতুক ব্যয় থেকে সরে আসতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া প্রকল্পের আওতায় বিদেশ সফর কিংবা বৈদেশিক প্রশিক্ষণ করা যাবে না। সেইসঙ্গে আরও যেসব খাতে ব্যয় না করলেও চলে সেসব ব্যয়ে লাগাম দিতে হবে। আমরা সেই কাজটি করছি। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সেই ধারাবাহিকতা থাকবে। ইতোমধ্যেই এনইসিতে অনুমোদন পাওয়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) কৃচ্ছ্র সাধনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া আগের চেয়ে অনেক কঠোর করা হয়েছে। আগে আমরা মোটা দাগে পরামর্শক খাতে এবং বিদেশ প্রশিক্ষণে বরাদ্দ দিতাম। কিন্তু এখন সত্যিই পরামর্শক লাগবে কিনা, কী ধরনের পরামর্শক, কতজন লাগবে, বিদেশ প্রশিক্ষণ কেমন হবে, কারা কারা যাবে- এসব খুঁটিনাটি বিষয় তলিয়ে দেখা হয়। ঢালাও বরাদ্দ দেওয়া হয় না।’
সারাবাংলা: চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) আশানুরূপ না হওয়ার কারণ কী?
এম এ মান্নান: এডিপির বাস্তবায়ন হিসাব করা হয় সবগুলো মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং সংস্থার ব্যয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু দেখা যায়, সবাই সমানভাবে কাজ করতে পারে না। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলেও এক্ষেত্রে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তারা অপক্ষাকৃত নিচের দিকের। অর্থাৎ পিডি নিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয় না। পিডিরা জুনিয়র অফিসার হওয়ায় তারা সবসময় উপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। যদিও অর্থ বরাদ্দের পর ছাড়ের প্রক্রিয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেটি কাজ করছে না। এখানেও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কাজ করে। সেইসঙ্গে বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পগুলোতে আরও নানা বিষয় যুক্ত থাকে। যেমন- যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ নিতে হয়। তাদের অনুমোদন ছাড়া কিছু করা যায় না। তাদের মধ্যেও তো আমলাতান্ত্রিকতা আছে। সবকিছু মিলিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন আশানুরূপ হয়নি। তবে আশা করছি, অর্থবছর শেষে আরএডিপির বাস্তবায়ন খুব খারাপ হবে না।
সারাবাংলা: এখন থেকে প্রকল্প সাহায্যের বদলে কি বৈদেশিক ঋণ বলা হবে?
এম এ মান্নান: তারা (দাতারা) এক সময় আমাদের অনুদান দিত। কিন্তু এখন অনুমোদন খুব কমে গেছে। তারা দিলে আমরা নিই, না দিলে চাই না। এজন্য তাদের আগে দাতা বলা হতো। কিন্তু এখন বলা হয় উন্নয়ন সহযোগী। এডিপিতে তাদের ঋণকে সবসময় লেখা হতো প্রকল্প সাহায্য (পিএ)। কিন্তু এখন থেকে আমরা লিখব- ঋণ সহায়তা। আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে, সেইসঙ্গে চিন্তা-চেতনায়ও। তারা ঋণ দেয় সুদসহ, আবার ফেরত নেয়। সেটাকে ঋণ বলতে তো আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম