চট্টগ্রামের ৫ জেলায় বেইলির বদলে হবে ‘পাকা সেতু’
৬ মে ২০২৩ ১৩:০৮ | আপডেট: ৬ মে ২০২৩ ১৫:৩১
বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ ও অপ্রশস্ত বেইলি সেতুর বদলে পাকা সেতু তৈরির একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। ইতোমধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) হেড কোয়ার্টারে পাঠানোর পর মাঠ পর্যায়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শুরু করেছে সওজের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় বেশ কয়েকটি সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তন্মধ্যে ১০০ মিটারের অধিক ১০টি সেতু গড়ে তোলা হবে পর্যটকবান্ধব হিসেবে নান্দনিক নকশায়। আগামী অর্থবছর থেকে প্রকল্পটির কাজ শুরু হতে পারে বলে আশা করছেন সওজের কর্মকর্তারা।
সওজ সূত্র জানিয়েছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক সড়কগুলোতে বেইলি সেতু নির্মাণ করে সওজ। তবে চার দশক আগে বসানো ওইসব বেইলি সেতুর বেশিরভাগই অপ্রশস্ত ও জরাজীর্ণ। যে কারণে বিভিন্ন সময়ে ঘটছে দুর্ঘটনায়। গত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বেইলি সেতু ধসে হতাহতের ঘটনার ঘটেছে।
এছাড়া বন্ধ হয়ে পড়েছিল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই অবস্থার উত্তরণে চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বেইলি সেতুর স্থলে আরসিসি গার্ডার ও পিসি গার্ডারসহ নান্দনিক সেতু প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলিক ব্যয় প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা ধরা হলেও চূড়ান্ত ডিপিপিতে বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, গেল বছরের ডিসেম্বরে পাঠানো প্রস্তাবিত ডিপিপিতে চট্টগ্রাম বিভাগের ৫ জেলায় সওজ চট্টগ্রাম জোনের আওতাধীন ৬টি সড়ক বিভাগের মাধ্যমে ৩৫টি আঞ্চলিক মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কে জরাজীর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ), অপ্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিদ্যমান ১০৫ বেইলি ও ৮টি আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে বেইলি সেতুসহ অন্যান্য সেতু প্রতিস্থাপনের ফলে সড়ক নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন, জনসাধারণের নিরাপত্তা, সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হবে। তবে তিন পার্বত্য জেলায় ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্য যে ১০টি বেইলি সেতু রয়েছে; সেগুলো পর্যটনবান্ধব হিসেবে নান্দনিকভাবে স্টিল সেতু করা হবে।
সওজ সূত্রে আরও জানা গেছে, ‘গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জরাজীর্ণ ও অপ্রশস্ত বিদ্যমান বেইলি সেতু/আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপন প্রকল্পে’র অধীনে চট্টগ্রাম বিভাগের ৫ জেলায় ৯৫টি পিসি গার্ডার সেতু, ১৮টি আরসিসি সেতু ও ৯টি বক্স কালভার্ট নির্মিত হবে। তন্মধ্যে ৪হাজার ৪৫৫ দশমিক ৬৩ মিটার পিসি গার্ডার, ৩৪৮ দশমিক ১২ মিটার আরসিসি গার্ডার ও ৬৯ দশমিক ৬৫ মিটার আরসিসি বক্স কালভার্ট করা হবে।
প্রকল্পে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের অধীনে ৮টি পিসি গার্ডার সেতু। দোহাজারী সড়ক বিভাগের অধীনে ৮টি পিসি গার্ডার ও ১টি আরসিসি গার্ডার সেতু। কক্সবাজার সড়ক বিভাগের অধীনে ১০টি পিসি গার্ডার ও ২টি আরসিসি গার্ডার সেতু। রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের অধীনে ১১টি পিসি গার্ডার, ১টি আরসিসি গার্ডার এবং ১টি আরসিসি বক্স কালভার্ট। খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের অধীনে ৯টি পিসি গার্ডার ও ৮টি আরসিসি বক্স কালভার্ট এবং বান্দরবান সড়ক বিভাগের অধীনে ৪৯টি পিসি গার্ডার ও ১৪টি আরসিসি গার্ডার সেতুর প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ হচ্ছে পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবশেষ গত ৭ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় মাইনি নদীর ওপর নির্মিত বেইলি সেতুটি পাথরবোঝাই ট্রাকসহ ধসে পড়ে। এতে খাগড়াছড়ির সঙ্গে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা ও সাজেক পর্যটন উপত্যকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘের এই সেতুটি রয়েছে নান্দনিক নকশার সেতুর তালিকায়।
এ ছাড়া ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি রাঙ্গামাটি সদর ও নানিয়ারচরের সীমান্ত কুতুকছড়ি বাজারের বেইলি সেতু ধসে ট্রাকচালক, সহকারীসহ তিনজন নিহত হয়। এ ঘটনার পর রাঙ্গামাটির সঙ্গে তাৎক্ষনিক খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির রাজস্থলীর বাঙালহালিয়ায় একটি বেইলি সেতু ভেঙে রাঙ্গামাটির সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ২১ আগস্ট রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার পোয়াপাড়ায় অবস্থিত বেইলি সেতুটি ধসে পড়ে। এতে করে উপজেলা সদরের সঙ্গে নাইল্যাছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর খাগড়ছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালী চৌমুহনীতে বেইলি সেতু ধসে দীঘিনালা উপজেলার সঙ্গে মেরুং ইউনিয়ন ও রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয় এবং তিনজন আহত হন। এর আগে, ২০১৮ সালের ১ আগস্ট বান্দরবানে বেইলি সেতু ভেঙে রুমা ও থানচি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। তিন পার্বত্য জেলার এমন অসংখ্য বেইলি সেতু ধসে হতাহত ও সড়ক যোগযোগ বন্ধের ঘটনা বিগত এক দশকে ঘটেছে। এতে করে অনিরাপদ হয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয় পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক সড়ক।
জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর রাঙ্গামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আলনূর সালেহীন সারাবাংলাকে জানান, সওজের একটি জোনাল প্রকল্পে চট্টগ্রাম জোনের ৬টি সড়ক বিভাগের অধীনে ৫ জেলায় ১০৫টি বেইলি সেতু ও ৮টি আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপনের মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে বেইলি থেকে আরসিসি গার্ডার ও পিসি গার্ডার সেতু প্রতিস্থাপনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হচ্ছে। চূড়ান্ত রিপোর্টের পর প্রকল্পটি পাস হলে ৫ জেলায় নিরাপদ সড়ক উন্নয়নে কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটির অধীনে তিন পার্বত্য জেলার ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্য ১০টি বেইলি সেতুকে পর্যটনবান্ধব নান্দনিক নকশায় করা হবে।
সওজ বান্দরবান বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দীন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সওজের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং আমাদের প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) সম্ভাব্যতা যাচাই ও আধুনিক নকশার কাজ করছে। যেটি বর্তমানে শেষ পর্যায়ে। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে পুরনো নকশায় আমরা প্রাক্কলিক তৈরি করেছি, তবে এখন বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। কিছু সেতু নান্দনিক নকশায় হবে। কাজ শেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা পুনরায় ডিপিপি পাঠাব, তখন প্রকল্পটি পাস হলে কার্যক্রম শুরু হবে।’
সারাবাংলা/ইআ