Saturday 28 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের করণকৌশল (পর্ব-০১)

ফাহিম ফেরদৌস
৩ মে ২০২৩ ১৪:১১ | আপডেট: ৭ মে ২০২৩ ১৮:০৬

জয় জয় সাধুগুরু বৈষ্ণব এর চরণে মস্তক দন্ডপাত
পৃথিবীর সমস্ত মানবতাবাদী মানুষের জয় হোক
বন্ধুপ্রতিম সমস্ত চলচ্চিত্র কর্মী, অনুরাগী সেবকের জয় হোক

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আন্দোলন নিয়ে কিছু বালার আগে প্রথমেই সমস্ত ভক্তি জ্ঞাপন করছি এ অঞ্চলের চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ শ্রী গুরুবৈ নমঃ মহম্মদ খসরুকে। তার নিজের সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’ কাগজের ৫ম সংখ্যায় তার পরিচয় পাওয়া যায় এভাবে-

ষাটের দশকের শুরুতে সংস্কৃতির মাটি খুঁড়ে যারা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের বীজ রোপণ করেছিলেন মুহম্মদ খসরু তাঁদের মধ্যে অন্যতম এবং সেই থেকে তিনি বিরতিহীন ‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’ নামক দীর্ঘ এক ছবি নির্মাণ করে চলেছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদটি ছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগতভাবে তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার নকশা কেন্দ্রের আলোকচিত্রী। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধ্রুপদী’ ও ‘চলচ্চিত্র পত্র’ এর সম্পাদক। যদিও ২০০০-২০০২ তিনি ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পায় বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। এর পর থেকেই ঢাকাই চলচ্চিত্র বিকাশ পায়। নির্দেশক আব্দুল জব্বার খানকে তাই স্মরণ করছি। ১৯৫৩তে ঢাকাই সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে কথা বলতে যখন জব্বার খানরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। সেজন্যই ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন গঠনের প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু। ফলশ্রুতিতে ইপিএফডিসি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সিনেমার চর্চা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই। কিন্তু মুল ধারার চলচ্চিত্র যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের নিয়ামক হয়ে পুঁজি ও শাসকের করতলে আবদ্ধ থাকে, সেখানে আমাদের আলোচনার কিছু নেই আপাতত। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন তার চেয়ে অনেক গভীর কিছুকে নাড়া দেয়, সিনেমার মুল শিল্প শক্তিকে উস্কে দেয়। সমাজ ও অর্থনীতির গন্ডীর সীমা ভেঙে শৈল্পিক ও মানবিক পৃথিবী গড়ার ইশারা দেয়।

বিজ্ঞাপন

ষাটের দশকে সারা পৃথিবী জুড়ে যখন বাঁধন ছেড়ার জয়গান শুরু হয়েছিল তখন বাংলাদেশেও কতকটা শিল্প বিপ্লবের আঁচ এসে লাগে। গান বা সাহিত্য চিন্তায় তার কিছু প্রতিফলন দেখা যায়, কিন্তু আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তখনতো মাত্র শুরু। ’৬৫ পরবর্তী জহির রায়হানকে তৎকালীন বাংলা সিনেমার একমাত্র আইকন বলা যায়। তবে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসেনি। বিকল্প চিন্তায় সময়ের কিছু অগ্রজ যেমন ওয়াহিদুল হক, সালাউদ্দিন জাকী, আনোয়ার হোসেন, মহম্মদ খসরুরা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরুর মধ্য দিয়ে ‘নেই’ এর দেশে একধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাজেদুল আউয়াল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে কালি ও কলম পত্রিকায় লিখছেন,

১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করে উদ্যোক্তারা সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও সেসব চলচ্চিত্র আস্বাদন-অনুধাবন-অধ্যয়ন-উপলব্ধি, সেগুলো নিয়ে আলোচনা, চলচ্চিত্র-বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ, সর্বোপরি রুচিবান দর্শক তৈরি করার সেই চেষ্টারই সূত্রপাত করেন। অন্যান্য চলচ্চিত্র সংসদের মতো পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদের কতিপয় লক্ষ্যবস্তু বর্তমান, যেমন নিয়মিত সৎ ও শিল্পছবি প্রদর্শন, চলচ্চিত্র আলোচনা অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র গ্রন্থাগার নির্বাহ, চলচ্চিত্র সংরক্ষণাগার স্থাপন, চলচ্চিত্র শিক্ষায়তন স্থাপন, চলচ্চিত্র পত্রিকা প্রকাশ, চলচ্চিত্র পুস্তক প্রকাশনালয় স্থাপন, চলচ্চিত্র উপলব্ধি সঞ্চারণ, সংসদ প্রেক্ষালয় স্থাপন, সৎ ও সৃজনধর্মী চলচ্চিত্রায়নে উৎসাহদান, চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিকতা বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

যদিও কলকাতার সত্যজিৎ রায়কে ততদিনে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম স্টার বলা যায়। ক্যলকাটা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে ১৯৪৭-এ, অপু ট্রিলজি বানানো শেষ, আর আমদের টনক তখন মাত্র নড়েছে। শিল্প বিপ্লবতো পরের কথা, আগে কিছু সিনেমাতো দেখি। ধ্রুপদীতে মহম্মদ খসরু মাহবুব আলমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কারণে কিভাবে ষাটের দশকের শিল্প আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত ছবিগুলো দেখার সুযোগ পাচ্ছেন তারা—

ষাটের দশক ছিল ১৯ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দশক। যেকোনো শিল্পকালার ক্ষেত্রেই এই দশকটি ছিলো হীরকমন্ডিত দশক, সবচাইতে সুজলা সুফলা পুষ্পিত দশক। মূলত পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকই ছিলো সুস্থ চলচ্চিত্রের বিস্তৃতি ও বিকাশের কাল। এ সময় বিশ্বব্যাপী বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। যেমন ইতালিতে নিও রিয়ালিজম, ফ্রান্সে ন্যূভেল ভোগ বা নিউ ওয়েভ, যুক্তরাজ্যে নিউ সিনেমা, যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমা ভেরিতে, সমাজতন্ত্রী দেশে সোশালিস্ট রিয়ালিজ্যম, জার্মানে নতুন সিনেমা ইত্যাদি। এইসব আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে নির্মিত কিছু ছবি তখন আমাদের দেখার সৌভাগ্য ঘটে। যেমন- ‘লা দলচাভিটা’, ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’, ‘এইট এন্ড হাফ’, ‘জুল এন্ড জিম’, ইত্যাদি। ভাইদা, কুরোশাওয়া, বুনুএল, ড্রায়ার, গদার, কাচিনা, ফাবরি, ইয়াঞ্চো, ভিস্কান্তি, জন ফোর্ড।

অবতরণিকা

চলচ্চিত্র আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তিলগ্নে পোড় খাওয়া হৃদয়বান ত্যাগী চলচ্চিত্র অনুরাগীদের একাংশকে এখানে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আজ অনেক বছর পর কোনো দৈবের ইশারায় এক নিভে যাওয়া বাতি জ্বলাতে আমরা হয়তো মিলিত হয়েছি। বিষয়- ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে নতুন করে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এর করণকৌশল খুঁজে দেখার চেষ্টা’। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিকে কোথায় নিয়ে যাবে সেই সম্বন্ধে এখনও ধারণা করা যাচ্ছে না। ২০৪৫ নাগাদ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সম্ভবত তার অনেক আগেই পৃথিবী ভিন্নকিছু অভিজ্ঞতা করতে যাচ্ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ, উন্নত যোগাযোগ ও স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াাই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরি করার জন্য বড়ো আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ এবং ইন্টারনেট অব থিংস কে একসাথে করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন একদল বিজ্ঞানী যারা জার্মান সরকারের জন্য একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল তৈরী করছিলেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ২০১৫ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে শব্দটিকে বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন। ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে আয়ত্ত করা’ ছিল ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ডেভোস-ক্লোস্টারস এ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভার বিষয়বস্তু। ১০ অক্টোবর, ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্র উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়। এটি (চতুর্থ শিল্প বিপ্লব) শোয়াবের ২০১৬ সালে প্রকাশিত বইয়ের বিষয় এবং শিরোনামও ছিল। শোয়াব এই চতুর্থ যুগের জন্য এমন সব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যেগুল হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং বায়োলজি (সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমস) কে একত্রিত করে এবং পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনের অগ্রগতির ওপর জোর দেয়। শোয়াব আশা করেন এই যুগটি রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অফ থিংস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অফ থিংস, ডিসেন্ট্রালাইজড কনসেনসাস, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের এবং সম্পূর্ণ স্বশাসিত যানবাহন এর ক্ষেত্রে উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত হবে। (উইকিপিডিয়া)

লেখাটা শুরু করতে গিয়ে বারবার দেখছি ‘আমি’ ঢুকে পড়ছে। শেষমেশ আমাকে বাদ দিয়ে লেখাটা লিখতে পারলাম না। কারণ আমার গল্প বলতে গিয়ে সময়ের হিরোদের একটা ট্রিবিউট করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এই গল্পের ‘আমি’ আসলে ‘আমি’ না। এই আমি অনেক আমির মধ্যে মিশে আছে। তবু রক্ত মাংসে যাকে দেখা যাচ্ছে তার জন্ম ১৯৭৯ সালে ঢাকার পল্লবীতে। সিনেমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মায়ের হাত ধরে। মনে পড়ে ছোটবেলায় ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে বাবার চাকরিসূত্রে যখন আমরা যশোর থাকি, আমাদের বাসা ছিল মণিহার সিনেমা হলের পেছনে আর আমার মায়ের ছিল সিনেমা দেখার নেশা। কারণে-অকারণে মা সিনেমা দেখতেন। ঢাকা থেকে খালা মামারা চাচারা আসত, মার বন্ধু-বান্ধব, বাবার বন্ধু-কলিগ, পাড়ার আন্টি, আমাদের দুই ভাইবোনের স্কুল সহপাঠীদের পরিবার সমেত এমন অনেক ছুতোয় একই সিনেমা বারবার দেখতে হত। দলবেঁধে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখতাম। ততদিনে আমি জানতামই না এই সিনেমা আমার জন্য একদিন কাল হবে; সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা-দহন-পীড়নের কারণ হবে। ততদিনে বাংলাদেশে খসরু ভাইদের চলচ্চিত্র আন্দোলন দুই যুগ পেরিয়েছে। ১৯৭১ এ শত বছরের শেকল ভেঙে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়ে গিয়েছি। পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ রূপান্তর হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদে। আরও গোটা বিশেক সংসদ নিয়ে ফেডারেশন তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রজেক্টের ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের কালোহাত চলচ্চিত্র শিল্পের এবং মুক্ত চিন্তার গলা টিপে ধরতে চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন এর মত কালাকানুন দিয়ে খসরু ভাইদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।

এতসব আমি জানি না, তবু সিনেমা দেখা চলতে থাকে। এবার আমাদের ঠিকানা ফরিদপুর শহর। আমি পঞ্চম শ্রেনিতে হয়ত পড়ি। বাসায় ভিসিআর এল। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলা আর হিন্দি ছবিতে আমাদের বাসা সয়লাব। পাড়ার সিনেমা হল হয়ে উঠল বাসা। এসবের মধ্যে এসময় আমার দেখা হয় সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপুর সংসার’, ‘অপরাজিতা’, ‘গোপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘গোপী বাঘা ফিরে এল’, কমল হাসানের ‘পুষ্পক’, ‘চার্লি চ্যাপলিন’ ইত্যাদি। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে পরিচয় আরও পরে। সব সিনেমাই ভাল লাগত কিন্তু এগুলো মনে হয় অবচেতনে আমার মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথেছিল যা আমার জীবনের সিনেমাপ্রীতির ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।

একসময় আমি দৈনিক পত্রিকা এবং ছোটো কাগজ সংগ্রহ করতাম। কালাকানুন এর কথা আমি প্রথম জানতে পারি ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে খসরু ভাইর সম্পাদিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের বুলেটিন চলচ্চিত্র পত্র থেকে। যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৯১’তে মূলত কালাকানুনের এক দশক পূর্তিতে। আর আমি পড়ছি তারও ১০ বছর পর। বইটির পাতায় পাতায় কালাকানুনের গ্লানি। মহম্মদ খসরু সম্পাদকীয়তে কালাকানুনের বিরুদ্ধে লিখছেন—

ষাটের দশকের শুরুতে এদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন সংগঠিত হবার মূহূর্ত থেকে একের পর এক যে বাধার প্রাচীর গড়ে উঠতে থাকে তার মধ্যে সর্বোচ্চো ছিলো প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলের চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন যা ক্রমশঃ এই আন্দোলনকে ক্ষয় করতে করতে এখন প্রায় নিঃশেষ করে এনেছে। চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে এই আইনকে ‘কালাকানুন’ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও চলচ্চিত্র সংসদ সমূহের কেন্দ্রীয় সংগঠন চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের নেতৃত্বের ক্ষমাহীন অযোগ্যতার কারণে তা অচিরেই স্তিমিত হয়ে আসে। সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনে দুঃসহ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলেও চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইনটি এখনও চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে। সুস্থ চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশের স্বার্থে চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের আবারও উচিত এই মুহূর্তে একাট্টা হয়ে এই কালাকানুন উপড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে আরেকটি আন্দোলন গড়ে তোলা।

কালাকানুন উপড়ে ফেলার আন্দোলন মানে তো তাকে ভয় পাওয়া না নিশ্চয়ই। তাহলেতো এটা আর আন্দোলন থাকে না। যে জিনিস জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে আছে তাকে সরানো যাচ্ছে না কেন? পরবর্তীতে আমরা যখন ২০০১ সালের দিকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেই তখনও খসরু ভাই কালাকানুনের সঙ্গে লড়াই করছেন। ২০০৯ সালে নুরুল আলম আতিকের ‘নতুন সিনেমা সময়ের প্রয়োজনে’ বইতেও কালাকানুনের গ্লানি দিয়েই তার লেখা শুরু করেছেন—

১৯৬৩ সালে এদেশে চলচ্চিত্র সংসদ বলে একটি ব্যাপার সূচিত হয়েছিল। হ্যা, চলচ্চিত্র সংসদ। রাজনৈতিক সংগঠন নয়। আন্দোলন এখানেও আছে। মানুষের অন্তরের রাজপথে। প্রয়োাজনে আবার কখনো রাজনীতিরও। চলচ্চিত্র নামক এই ম্যাজিশিয়ানের নানান মুদ্রার নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে, মানবমনে এর গভীর গভীরতর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে, সিনেমাকে ভালোবেসে জন্ম নিয়েছিলো চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। এদেশে ভালো ছবি দেখার আয়োজন, পঠন-পাঠন, সেইরকম ছবি নির্মাণের ভিত্তিভূমি তৈরির জন্য। আর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ নামক ভবনটি নির্মাণ করতে যিনি জীবনপাত করেছেন তিনি শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ খসরু। স্থপতি তিনি, সিনেমার; স্বপ্নের । মুহম্মদ খসরু স্বপ্ন দেখেছিলেন। পথও দেখিয়েছেন। সেই পথে হেঁটেছেন অনেকে, পথেপথে ম্যাজিক দেখিয়ে দক্ষিণার কলাটা-মূলোটা ঝোলায় পুরতে পেরেছেন কেউ কেউ। একপর্যায়ে এইযাত্রার উদ্দেশ্য ভুলে অন্যপথে মনোযোগী হয়ে পথ হারিয়েও ফেলেছেন অনেকে। পথিক, তুমিও কি পথ হারাইয়াছো? শুধু পথ নয়, পথের মানচিত্র নয়, পথিক আজ নিজেকেই হারাতে বসেছে। আমাদের ম্যাজিশিয়ান আজ পথে বসেছে। দর্শক আর কতোকাল অপেক্ষায় থাকবে? সে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঘরের হোম থিয়েটারে, টিভির স্যাটেলাইট চ্যানেলে। ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে নয়া কালচার-মোবাইল ফোনে। আর চলচ্চিত্র সংসদগুলো দেশবিদেশের যে ছবিগুলো দেখার আয়োজন করে তা এখন ডিভিডিতেও ততো দুর্লভ নয়। অতোপথ মাড়িয়ে, সংসদের আয়োজনে বিদেশি কালচারাল সেন্টারের ভিডিও প্রজেক্টরে ডিভিডিতে ছবি দেখে কিইবা এমন ফারাক। কোথায় সেই প্রজেক্শন হলের ম্যাজিক? তাই চলচ্চিত্র সংসদের কর্মকাণ্ড- সিনেমার আলাপচারিতা, অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স, ওয়ার্কশপ, ফেস্টিভ্যাল বিশেষ জুত করতে পারছে না। আর তেমন কী-ই বা সে আয়োজন করতে পারে এই অন্ধবিলাসী অস্থির জনস্রোতের বিভ্রান্ত মনের জন্য? আন্দোলনের পার্টটুকু তো মাঠেমারা গিয়েছে সেই কবে। সংসদ বিষয়ক কালাকানুন, আর্কাইভের জীবন্ত উপস্থিতির দাবি, চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদানে অব্যবস্থাপনা ইত্যাকার নানা প্রসঙ্গে ইতিউতি দাবি উত্থাপন করা হলেও কোনো ফল সে নিজের হাতের মুঠোয় ধরতে পারেনি। লাফালাফিই সার। তবে চলচ্চিত্র সংসদের ম্রিয়মান এই ঝুলিতে কিছু দামী পাথর আছে, সেগুলি মাঝেমধ্যে বের করে দেখে তৃপ্তি পেতে পারি প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তানের মতো। এই যেমন, মুহম্মদ খসরুর সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলন ধ্রুপদী। ‘ধ্রুপদী’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র সংকলন। মসিউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর চলচ্চিত্র সূর্যদীঘল বাড়ী, মোরশেদুল ইসলামের আগামী ও চাকা, তারেক মাসুদের আদম সুরত এসবই চলচ্চিত্র সংসদের ঝিনুকে জন্ম নেয়া মুক্তা সমুদয়। কিন্তু তারপর? পথিক, তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে নিজপথ।

এখানে বোঝা যাচ্ছে নির্মাতার হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরার গল্প। স্যাটেলাইট, হোম থিয়েটার আর মুঠোফোন এর বিকল্প স্ক্রিনিং বিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন কিন্তু তখনও ওটিটি বা ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের খবর নেই। এখানে কালাকানুনের চেয়ে দর্শকের জন্য মানসম্পন্ন কন্টেন্ট না থাকার কারণে তার অপেক্ষার বাঁধ ভাঙার কথা বলা হচ্ছে। এও বলা হচ্ছে যে, লাফালাফি করে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন আর জমছে না। কয়েকটা বিরল ইতিবাচক ঘটনার নাম করে আসলে বললেন নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। তাইতো! আমার পথ আমি খুঁজে নেব বলেই সিনেমার জন্য ঘর ছেড়েছিলাম। ২০২৩ সালে এসে যদি আমরা কালাকানুনকে ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট এর পথের কাঁটা ভেবে কমপ্রোমাইজড কোনো সমাধান খুঁজি তাহলে পরবর্তী জেনারেশন আমাদের নামে হাসতে হাসতে ছাগল কোরবানি দেবে। চলচ্চিত্র সংসদ কালাকানুন আর সেন্সরবোর্ড আমার কাছে একি ইন্সটিটিউশনাল আইডিয়া মনে হয়। এসব ধারণার মধ্যে আমরা নিজেরাই আটকে গিয়েছি। অন্য অনেক কিছুকে দায় বানিয়ে নিজেদের অদক্ষতাকে আড়াল করার অভ্যাস মাত্র। আসলে কিছু করার দক্ষতা থাকলে আমারা করে দেখাতে পারতাম। আমাদের আসল সংকটের স্বরূপ হলো আত্মপরিচয়হীনতা।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর