ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩২৮, আহত ৫৬৫
২ মে ২০২৩ ১৬:০৮ | আপডেট: ২ মে ২০২৩ ১৬:২১
ঢাকা: এবার ঈদুল ফিতরে যাতায়াতের (১৫-২৯ এপ্রিল) ১৫ দিনে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩২৮ জন নিহত ও ৫৬৫ জন আহত হয়েছেন, যা গত বছরের চেয়ে কম।
মঙ্গলবার (২ মে) সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঈদের আগে ও পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে সড়কে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগ মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৬৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত, ১২০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ। নিহতের ৫১ শতাংশ এবং আহতের ২১ দশমিক ৩ শতাংশ প্রায়।
এই সময় সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ৮৮ জন চালক, ১৬ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪২ জন পথচারী, ৪৮ জন নারী, ৪০ জন শিশু, ১৭ জন শিক্ষার্থী, একজন সাংবাদিক, পাঁচজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, চারজন শিক্ষক, পাঁচজন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছয়জন চিকিৎসকের পরিচয় মিলেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন দৈনিক এ প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে বলে উল্লেখ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সেখানে আরও বলা হয়, এবারের ঈদে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত গরমসহ নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ মানুষের কম যাতায়াত হয়েছে। বর্তমান সরকারের বিগত ১৪ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভাল ছিল। ঈদের ছুটি একদিন বাড়ানোর সুফল। দেশের সবকটি সড়ক মহাসড়কের পাশাপাশি পদ্মাসেতুতে মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচলের কারণে মোট যাত্রীর ১৮ দশমিক ২ শতাংশ মোটরসাইকেলে যাতায়াত, সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারীর কারণে এবারের ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক হয়েছে। এ কারণে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, প্রাণহানি ২১ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে।
আরও উল্লেখ করা হয়, মোট যানবাহনের ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কার মাইক্রো জিপ, ৪ দশমিক ৬ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ৬ দশমিক ৭ শতাংশ অটোরিক্সা, ১২ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যাটারী রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, ও ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। সংগঠিত দুর্ঘটনার ২৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২০ দশমিক ৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারনে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এ ছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার এই চিত্রকে একটি নমুনা রির্পোট বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মতো বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে তা সংবাদমাধ্যমে আসে না। তাই এসব দুর্ঘটনার হিসাব রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এবারের ঈদে শুধু মাত্র ঈদের দিনে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর সময় দুর্ঘটনায় ২১৬ জন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে ৯৬ জনের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। ঈদের দ্বিতীয় দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত ১০৫ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ৩৫ জনের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। কেবল পঙ্গু হাসপাতালে এই দুইদিনে ভর্তি রোগীর সমপরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনার খবরও সংবাদপত্রে আসেনি। ফলে এসব দুর্ঘটনার ভয়াবহতার খবর আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরতেও পারা যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।’
আরও বলা হয়, সড়ক, রেল ও নৌ পথে গত ১৪ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে সড়ক মহাসড়কের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। এসব সড়কে মানসম্মত বাসের অভাবে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ইজিবাইকের মতো ছোট পরিবহন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। তিনি মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধের পাশাপাশি গণপরিবহনকে বিকশিত করার দাবি জানান।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তাদের প্রতিবেদনে আটটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-
১. দেশের সড়ক মহাসড়কে মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল।
২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মাকিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো।
৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টানিং চিহ্ন না থাকার ফলে নতুন চালদের এসব সড়কে দুঘটনায় পতিত হয়েছে।
৪. মহাসড়কের নির্মান ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাদাঁবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন।
৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া যানবাহন চালানো।
দুর্ঘটনার প্রতিরোধে সুপারিশসমূহ:
১. জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানী ও নিবন্ধন বন্ধ করা।
২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান।
৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।
৫. সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।
৬. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা।
৭. সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে বাস্তবায়ন করা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা।
৮. গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।
উল্লেখ্য, সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল প্রতি বছরই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। সে ধারাবাহিকতায় এবারও প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর ঈদ কেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানীর বিষয়টি দীর্ঘ ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে।
সারাবাংলা/জেআর/ইআ