Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হারিয়ে যাচ্ছে টেপা পুতুল

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৪ এপ্রিল ২০২৩ ২০:২১ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ২০:২৭

ঢাকা: হাত দিয়ে টিপে টিপে নানা আকারে গড়া পুতুল। নাম তাই টেপা পুতুল। এলাকাভেদে বলে পুতলা। হারিয়ে যেতে বসেছে এই টেপা পুতুল।

বাবা-মায়ের হাতে ধরে বৈশাখী মেলায় যাওয়া ছোট্ট বাঙালি শিশুটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই পুতুল। আর কুমাররাও তাই হাড়ি-পাতিলের পাশাপাশি আলাদা করে ঝাঁকা ভরে মেলায় আনেন নানা আকার আর ধরনের মাটির পুতুল। হাতি, ঘোড়া, শিশুকোলে মা, মেয়ে শিশুর আকৃতির এসব পুতুল ঘিরে কচিকাঁচাদের হাসিমুখের আনাগোনা। আবহমান গ্রাম বাংলার বৈশাখী মেলার এটি ছিল পরিচিত দৃশ্য।

বিজ্ঞাপন

আধুনিক সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ছাঁচে ফেলে উপহার বা শো-পিস হিসেবে হাজার হাজার পুতুল গড়া হলেও মেলায় যেয়ে হাতে গড়া পুতুল কেনার সেই দিন প্রায় হারিয়েই গেছে। এখনও ধুঁকে ধুঁকে যতোটা টিকে আছে উদ্যোগ না নিলে কালের গর্ভে তাও হারিয়েই যাবে।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে ঐতিহ্যবাহী টেপা পুতুল হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাজারে চাহিদা না থাকা, বৈশাখী মেলা না হওয়া বা সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া, নদী ও খাল শুকিয়ে যাওয়া, পুতুলের মান পড়ে যাওয়া, কুমারদের বেশি লাভের চিন্তা করা, কুমারদের নতুন প্রজন্মের আগ্রহ না থাকা ও দেশত্যাগ, ধর্মীয় আগ্রাসন, কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রভাব এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।

খাল-বিল-নদী-নালার দেশ বাংলাদেশ। পলি জমে গড়ে উঠেছে সমভূমি। সেই দেশের মানুষের জীবনযাপনে মাটি আর জল তাই মিলেমিশে একাকার। কাঁদামাটি দিয়ে গড়া হাঁড়িপাতিল যেমন প্রতিদিনের সঙ্গি, তেমনি শিশুদের আনন্দ বিনোদনের সঙ্গী মাটির পুতুল। মূলত গ্রামের দাদা-দাদী, নানা-নানীরা নাতি-পুতিদের জন্য হাতে গড়ে চুলায় পুড়িয়ে মাটির পুতুল বানাতেন যা ছিল গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের অংশ।

বিজ্ঞাপন

আজ থেকে আনুমানিক ১৫ হাজার বছর আগে মানুষ মাটির পুতুল বানাতে শুরু করে। বিশ্বের প্রায় সকল সভ্যতাতেই রয়েছে এর অস্তিত্ব। এসব পুতুলে মাতৃরূপের নানা প্রকাশ দেখা যায়, যা বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের টেপা পুতুলেও দেখা গেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মাটির পুতুলের চেহারাতেই ধরা পড়ে সেসব এলাকার চেহারার বৈশিষ্ট্য। তেমনি আমাদের দেশের টেপা পুতুলেরও রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট যা আবার এলাকাভেদে ভিন্ন। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ছাড়াও রাজশাহী, বরিশাল, ফরিদপুর, বগুড়া, শেরপুর, নওগাঁ, আত্রাই, ঢাকার সোনারগাঁও, ধামরাই, সাভারসহ দেশের নানা অঞ্চলে এখনও ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে টেপা পুতুল। খেলনা থেকে এটি বর্তমানে ঘর সাজানোর উপাদানে পরিণত হলেও কিছু কিছু জায়গায় এখনও এটি রীতি-রেওয়াজের অংশ।

সাভারের নয়ারহাটে ঘোড়া পীরের মাজার এমনই একটি স্থান। যুগ যুগ ধরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি এখানে ঘোড়া পীরের কাছে মানত করে। এখানে মানতের জন্য প্রয়োজন হয় মাটির তৈরি ঘোড়া আকৃতির টেপা পুতুল। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই পুতুল ঠিকমতো না পুড়লে অমঙ্গল হতে হবে। তাই কাঁচা বা অর্ধপোড়া নয়, হাতে তৈরি পোড়ানো মাটির ঘোড়া-ই দিতে হবে এখানে। এছাড়াও কর্পোরেট কালচারের অংশ হিসেবে পয়লা বৈশাখের উপহারের থালা বা ঝুড়িতেও জায়গা করে নিয়েছে টেপা পুতুল। তবে সেটি টেপা পুতুলের আদিম সংস্করণ নয়। হাতে গড়া টেপা পুতুলের মধ্যে আদিমতার ছাপ রয়েছে যা তৈরির ধারাটি আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে।

রাজধানীর দোয়েল চত্বরে হস্তশিল্পের বেশ বড় একটি বাজার রয়েছে। এখানে মাটি, বাঁশ, কাঠ, বেতসহ নানারকম হস্তশিল্পের দরকারি ও গৃহসজ্জার জিনিস পাওয়া যায়। এখানকার কয়েকটি দোকানে মাটির তৈরি টেপা পুতুল পাওয়া যায় যা মূলত হাতি, ঘোড়া ও মেয়ে আকৃতির। জানা গেল পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এগুলো নিয়ে এসেছেন তারা। সারাবছর তেমন একটা বিক্রি নেই। আবার পয়লা বৈশাখেও খুচরা নয়, মূলত পাইকারি হারে বিক্রি হয় এই পুতুল। বিভিন্ন অফিসে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে তৈরি উপহারের থালা বা ঝুড়ির মধ্যে থাকে একটি করে হাতি-ঘোড়া-মেয়ের পুতুল। সাধারণত ১০০ থেকে পাঁচ হাজার পিসের অর্ডার থাকে তাদের কাছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান সুপার মার্কেটে বিক্রির জন্য বাজারজাতও করে সব ঝুড়ি। কর্পোরেট অর্ডারের এসব পুতুল মূলত আসে ঝালকাঠি থেকে। এই মার্কেটে টেপা পুতুলের খুচরা বিক্রি নেই বললেই চলে।

রাজধানীর রায়েরবাজারে মাটির জিনিসের দোকান রয়েছে বিক্রমপুরের প্রদীপ পালের। বেচাবিক্রি না থাকায় ব্যবসা গোটানোর চিন্তা করছেন তিনি। বৈশাখের সময় টেপা পুতুলের বিপুল চাহিদা থাকলেও বর্তমানে সেটি নাই। ফলে শুধু মাটির টব, ব্যাংক ও হাঁড়িপাতিল বিক্রি করে পোষাচ্ছে না। কয়েক বছর আগেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বৈশাখী মেলায় রাত দুটো পর্যন্তও বেচাকেনা করেছেন। কিন্তু এখন বৈশাখী মেলার সময় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নির্ধারিত করে দেওয়ায় অনেক জায়গাতেই মেলা হয় না, হলেও তারা আগের মত পসার জমাতে পারছেন না।

২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলার পর থেকে শুধু রাজধানীতেই নয়, পুরো দেশেই পয়লা বৈশাখের আয়োজনে ভাটা পড়েছে বলে অভিযোগ করেন প্রদীপ পাল।

পাল বংশের লোকজন বংশানুক্রমে মাটির জিনিসপত্র নির্মাণ করেন। তারাই আজকাল আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন এই পেশায়। প্রদীপ পাল বলেন, আগে এই রায়েরবাজারেই দুই-তিনশ পাল পরিবার বাস করত, এখন মাত্র চার-পাঁচ গরের বাস। সবাই চলে গেছেন ঝালকাঠি বা নিজ নিজ জেলায়। মাটির জিনিসের বাজার না থাকায় এবং চারপাশে বড় বড় ভবন নির্মাণের ফলে পালরা এলাকা ছেড়েছেন।

আগে বসিলা বা গাবতলী থেকে মাটি এনে জিনিস বানালেও এখন মাটি কিনতে হয় বলে জানান প্রদীপ পাল। ফলে পোষাতে না পেরেও অনেকে চলে গেছেন পেশা ছেড়ে। তবে সেখানেও তাদের নানামুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আগে নদী ও খাল থেকে ইচ্ছামত মাটি আনলেও এখন কিনে নিতে হয়। এছাড়া ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় মালামাল পরিবহনের খরচও বেড়েছে। এর ফলে একেকটি টেপা পুতুলের দাম পড়ছে আকারভেদে ৪০ থেকে ১২০ টাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক স্বপন কুমার শিকদার প্রায় নয় থেকে দশ বছর মৃৎশিল্পী মরনচাঁদ পালের সঙ্গে কাজ করেছেন। বলেন, টেপা পুতুল আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু এখন সেটা বিলুপ্তপ্রায়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে উপহারের জন্য ও বিদেশে রফতানির উদ্দেশ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে ছাঁচে ফেলে কিছু পুতুল উৎপাদন হলেও হাতে তৈরি পুতুল কোনক্রমে টিকে আছে। বর্তমানে নদী-নালা শুকিয়ে যাওয়া, পালদের নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, বাজার না থাকাসহ নানা কারণে মৃৎশিল্প হুমকির মুখে। আগে যেমন খেলার জন্য পুতুল কিনত মানুষ এখন তো সেটা নাই। এখন সাধারণত ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্যই এগুলো কেনে। তাই সময়ের প্রয়োজনে আমাদের টেপা পুতুলও আধুনিকভাবে যত্ন নিয়ে তৈরি করতে হবে। আমি নিজে বর্তমান বাজার উপযোগী নতুন ডিজাইনে পুতুল বানাই ও দেশের বিভিন্ন এলাকার পালদের সেগুলো বানাতে বলি। কিন্তু দেখা যায় তারা সময় দিয়ে যত্ন নিয়ে বানাতে চায় না। পাঁচটার পরিবর্তে যত্ন নিয়ে তিনটা পুতুল বানালেও তো লোকে কিনবে। কিন্তু দেখা যায় পালরা আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে। নানা প্রতিকূলতায় তাদের সন্তানরাও এখন পেশা পরিবর্তন করছেন দলে দলে। অনেকে আবার ভারতে চলে গেছেন। কলকাতার দত্তপুকুরের পালপাড়া গড়েই উঠেছে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শিল্পীদের নিয়ে। আমাদের দেশেও যেটুকু সম্ভাবনা আছে তা আমরা চাইলেই কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়েও আগ্রহের ঘাটতি। শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের বিক্রয় কেন্দ্রে পর্যন্ত চাইনিজ পুতুল বিক্রি করে। এভাবে জাতীয় জাদুঘর বা অন্যান্য জায়গায় যদি শুধুমাত্র দেশীয় পণ্য বিক্রি হত তাহলেও মানুষ চাইনিজ বা অন্যান্য পুতুল না কিনে দেশের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এগুলোই কিনত।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আমার শৈশব কেটেছে বগুড়ায় করতোয়া নদীর ধারে। সেই পঞ্চাশের দশকে ছোট ভাইবোন, আব্বার অফিসের কলিগের ছেলেমেয়েরা মিলে একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম, বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। এভাবেই আমরা দলবেঁধে বৈশাখী মেলায় যেতাম। মেলায় ঘুরতাম, মাটির পুতুল, হাড়ি-পাতিল, গরু, ঘোড়া কিনতাম, বাসায় এনে সেগুলো নিয়ে খেলতাম। বর্তমানে পয়লা বৈশাখের সেই জমজমাট আয়োজন অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে।

সারাবাংলা/আরএফ/রমু

টেপা পুতুল পহেলা বৈশাখা বাংলা নববর্ষ

বিজ্ঞাপন

চলে গেলেন প্রবীর মিত্র
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৪২

আরো

সম্পর্কিত খবর