মুফতি হারুনের জামিননামায় হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন!
৩ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৪৩ | আপডেট: ৩ এপ্রিল ২০২৩ ২২:২৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনায় দায়ের হওয়া এক মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান হেফাজতে ইসলামের সাবেক শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজাহার। জামিনের শর্ত ছিল, তার পাসপোর্ট বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে। জামিননামা জমা দিয়ে বিচারিক আদালতে দাখিল করা অঙ্গীকারনামায় হারুন ইজাহার জানান, গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পাসপোর্ট জব্দ করেছিল এবং সেটি আর ফেরত দেয়নি।
বিচারিক আদালত চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) কামরুন্নাহার রুমী এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রামের হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা দেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয়ের তথ্য সংযুক্ত করে আদালতকে জানান, হারুন ইজাহারের পাসপোর্টই ছিল না।
এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিজেএম হারুন ইজাহারের জামিননামা গ্রহণ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। চট্টগ্রাম কারাগারে এরইমধ্যে জামিননামা পৌঁছেছে। তবে বিচারিক আদালতের এই আদেশ উচ্চ আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন বলে মনে করছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিও একই মত দিয়ে বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ প্রবীণ আইনজীবী আহসানুল হক হেনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইকোর্ট বিচারিক আদালতকে পাসপোর্ট জমা নিতে বলেছেন। এটি হাইকোর্টের অর্ডার। এখন জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তির যদি পাসপোর্ট না থাকে, সেই তথ্য ট্রায়াল কোর্টকে উচ্চ আদালতকে অবহিত করতে হবে। তখন উচ্চ আদালত এ বিষয়ে যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবে ট্রায়ার কোর্ট কাজ করবেন। অন্যথায় ফৌজদারি কার্যবিধি মতে, সেটা এখতিয়ারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে হাইকোর্টের আদেশের স্পষ্টত লঙ্ঘন হয়েছে।’
হারুন ইজাহার বহুল আলোচিত চট্টগ্রামের জামেয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া লালখান বাজার মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি ইজাহারুল ইসলামের ছেলে। জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বরাবর আলোচিত বাবা-ছেলে উভয়ই হেফাজতে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অভিযোগ আছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ প্রতিষ্ঠার পর লালখান বাজার মাদরাসায় প্রশিক্ষণ হয়েছিল এবং ইজাহারুল ইসলাম সংগঠনটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
২০১৩ সালে লালখান বাজার মাদরাসায় গ্রেনেড বানানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু গ্রেনেড ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে। এরপর হারুন ইজাহারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার বাবা পালিয়ে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে আসেন। মোদীর আগমনের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের ডাকে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ২১ এপ্রিল সন্ত্রাস বিরোধী আইনে হাটহাজারী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় ২৯ এপ্রিল হারুন ইজাহারকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাটহাজারী থানার মামলায় হারুন ইজাহারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর তাকে জামিন দেন বিচারপতি মুস্তফা জামান ইসলাম ও মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। আদালত জামিন আদেশে আসামিকে বিচারিক আদালতে পাসপোর্ট জমা দেওয়া এবং বিচারিক আদালতের অনুমতি ব্যতীত দেশত্যাগ না করার শর্ত দেন।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের আদেশনামা চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এসে পৌঁছে। আসামির স্বাক্ষর ও অঙ্গীকারনামাসহ আদালতে জামিননামা দাখিল করেন হারুনের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী। অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ আছে, ২০০৯ সালের ৪ মার্চ হারুন ইজাহারকে বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন পাসপোর্ট জব্দ করে নিয়ে যায়। সেই পাসপোর্ট আর তিনি ফেরতও চাননি এবং এর ফলে নবায়নও করা হয়নি। পাসপোর্টটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার অফিস থেকে আদালতে বেইলবন্ড জমা দেওয়া হয়েছিল। হারুন সাহেবের পাসপোর্ট নেই। কারণ সেটি ২০০৯ সালেই পুলিশ জব্দ করেছিল। এরপর তিনি বেশিরভাগ সময় কারাগারে ছিলেন। ফলে পাসপোর্টটা ফেরতও নেওয়া হয়নি, নবায়নও করা হয়নি। ১৩ বছর পর সেই পাসপোর্টের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, আমরা সেটা আদালতকে অবহিত করেছি। আদালত আমাদের বক্তব্য শুনে পুলিশকে তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।’
আদালতের নির্দেশে তদন্ত শেষে গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত দায়িত্বে হাটহাজারী সার্কেল) এবিএম নায়হানুল বারী প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হারুন ইজাহারকে গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে পাসপোর্ট জব্দের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে জমা দেয়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, হারুন ইজাহারের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন নম্বর যাচাই করে তার নামে কোনো পাসপোর্ট পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পরিদর্শক (প্রসিকিউশন) জাকের হোসাইন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছি যে, হারুন ইজাহারের কোনো পাসপোর্ট পাওয়া যায়নি। তখন আদালত হাইকোর্টের আদেশমূলে জামিননামা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।’
চট্টগ্রামের সিজেএম আদালতের নাজির আবু তাহের সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের পর সিজেএম আদালত থেকে জামিননামা রোববার (২ এপ্রিল) চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হারুন ইজাহারের একটা জামিন আদেশ আমরা গতকাল (রোববার) পেয়েছি। তবে এই মুহুর্তে তার মুক্তির সম্ভাবনা নেই। তার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা আছে। কয়েকটি মামলায় জামিন হয়েছে। আরও মামলা আছে।’
হাইকোর্টে হারুন ইজাহারের জামিন আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নিয়েছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান। সারাবাংলার কাছ থেকে বিষয়টি জেনে তিনি অভিমত দিয়েছেন, বিচারিক আদালতের জামিননামা কারাগারে পাঠানো সমীচীন হয়নি।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান বলেন, ‘হাইকোর্ট পাসপোর্ট জমা নেওয়ার শর্ত দিয়েছেন। যেহেতু আসামি পাসপোর্ট জমা দিতে পারেননি, বিষয়টি উচ্চ আদালতকে অবহিত করা প্রয়োজন ছিল। আমি পাবলিক প্রসিকিউটরের মাধ্যমে বিষয়টি যাচাই করব। জামিননামা রি-কল করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পিপি অফিসকে বলা হবে। এরপর প্রয়োজনে এটি হাইকোর্টের নজরে আনা হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা পিপি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশের অ-আ, আকার-ইকারের ব্যত্যয় ঘটানোর কোনো সুযোগ নিম্ন আদালতের নেই। আমি জানতে পেরেছি যে, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পাসপোর্ট জমা নেওয়া ছাড়াই একজন আসামির জামিননামা গ্রহণ করে সেটি কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে আমার কাছে যদি সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা এ বিষয়ে জানতে চান, তাহলে আমি হাইকোর্টের আদেশের ভিত্তিতেই মতামত দেব।’
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পরিদর্শক (প্রসিকিউশন) জাকের হোসাইন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে আদালত প্রতিবেদন চেয়েছিলেন, আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। বাকিটা সিজেএম কোর্ট এবং হাইকোর্টের এখতিয়ার। এখানে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।’
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিজেএম আদালতের নাজির আবু তাহের সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে কোনো ব্যাখা নেই। আপনি প্রয়োজনে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’
সারাবাংলা/আরডি/একে