চট্টগ্রামে আ.লীগের ওয়ার্ড সম্মেলন ফের শুরু, একাংশের বর্জন
১৮ মার্চ ২০২৩ ২৩:১৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে ওয়ার্ড পর্যায়ে ফের সম্মেলন শুরু করেছে নগর আওয়ামী লীগ। তবে যথারীতি এই সম্মেলন নিয়ে বিভক্ত নগর কমিটির নেতারা।
শনিবার (১৮ মার্চ) একপক্ষের বিরোধিতার মধ্যে সম্মেলন হয়েছে নগরীর বাগমনিরাম ওয়ার্ডে। সম্মেলনে নগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। তবে মাহতাব-নাছিরের বিরোধী হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা এ সম্মেলন বর্জন করেছেন।
অন্যদিকে, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বাগমনিরাম ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা সম্মেলন প্রত্যাখান করে বিক্ষোভ করেছেন।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পর্যন্ত গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। সভানেত্রী ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করার তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু একমাসের মাথায় নগর আওয়ামী লীগ ওয়ার্ড পর্যায়ে যে সম্মেলন শুরু করেছে, তাতে সভানেত্রীর নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ মাহতাব-নাছির বিরোধী নেতাদের।
শনিবার সকালে নগরীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বাগমিনরাম ওয়ার্ডের সম্মেলন উদ্বোধন করেন। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদ্যবিদায়ী কমিটির সভাপতি চসিক কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দীনের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহ-সভাপতি নঈম উদ্দীন চৌধুরী, সুনীল কুমার সরকার, উপদেষ্টা সফর আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমদু, হাসান মাহমুদ হাসনী, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক মুহাম্মদ হোসেন, মহিলা সম্পাদক জোবাইরা নার্গিস খান, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী, নির্বাহী সদস্য সাইফুদ্দীন খালেদ বাহার, আব্দুল লতিফ টিপু, জাফর আলম চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন নেতা বক্তব্য দেন।
সম্মেলন উদ্বোধন শেষে একাংশের বিরোধিতার মধ্যে মাহতাব-নাছির ও তাদের অনুসারী নগর নেতাদের উপস্থিতিতে কাউন্সিল অধিবেশনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আব্দুল আজিম সভাপতি ও সাইফুল ইসলাম বাবু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে সম্মেলন হয়েছে বাগমনিরাম ওয়ার্ডের বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল বশরকে ছাড়াই। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই নেতার অভিযোগ, সম্মেলনের প্রস্তুতিসহ কোনো পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এমনকি তিনি সাধারণ সম্পাদক হলেও সম্মেলনের বিষয় সভাপতি গিয়াস উদ্দিন তাকে একবার অবহিতও করেননি।
আবুল বশর সারাবাংলাকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদকের সই ছাড়া কাউন্সিলরের তালিকা বৈধ নয়। তারা আমার কোনো সই ও মতামত না নিয়ে সম্মেলন করেছে। এ সম্মেলন অবৈধ। এর আগেও তারা কয়েকবার গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশে স্থগিত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আবার তারা কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে একটি বিতর্কিত সম্মেলন সম্পন্ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে বাগমনিরাম ওয়ার্ডে দলের মধ্যে যে বিভক্তির সূচনা হল, এর দায় তাদের ওপর বর্তাবে।’
জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদককে অবহিত করা হয়নি, এটা মিথ্যা তথ্য। উনাকে বলা হয়েছে। কিন্তু উনি বার বার আমাদের অবজ্ঞা করে সম্মেলন বানচাল করতে চেয়েছেন নিজের পদ ধরে রাখার জন্য। উনি ৩২ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক। অথচ সম্মেলন করতে বললে বার বার পাশ কাটিয়ে যান। সর্বশেষ উনি আমাদের জানিয়েছেন, উনাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি করা না হলে সম্মেলনে আসবেন না। এই নিশ্চয়তা আমরা উনাকে দিতে পারিনি। সেজন্য উনি আসেননি। গত একবছর ধরে উনি সংগঠনের কোনো কর্মকাণ্ডে নেই। আমরা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একজনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে সম্মেলন সম্পন্ন করেছি।’
এদিকে, সম্মেলন চলাকালেই নগরীর দামপাড়া মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন আবুল বশরসহ উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারী নেতোরা। এতে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিম, নগর যুবলীগের সাবেক সদস্য শেখ নাছির আহমেদ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কফিল উদ্দিন, আলী রেজা পিন্টু, চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ, বাগমিনরাম ওয়ার্ডের শেখ শওকতউল্লাহ সোহেল বক্তব্য দেন।
শেখ নাছির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম গঠনতন্ত্র মোতাবেক ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মেলনটা হোক। আমরা বার বার তাদের অনুরোধ করেছি। কিন্তু উনারা আবুল বশরসহ আওয়ামী লীগের একাংশকে বাদ দিয়ে একটি বিতর্কিত সম্মেলনের আয়োজন করেন। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। এই সম্মেলন কেন্দ্রের নির্দেশ এবং গঠনতন্ত্রের বিধির বরখেলাপ বলে আমরা মনে করি।’
মাহতাব-নাছির বিরোধী হিসেবে যারা গণভবনে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম অন্যতম। বাগমনিরাম ওয়ার্ডের সম্মেলনে এই নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। যুগ্ম সম্পাদক বদিউল আলম, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শফিক আদনান, চন্দন ধর, মশিউর রহমান, ইফতেখার সাইমুল চৌধুরীসহ অধিকাংশ দায়িত্বশীলও সম্মেলনে যাননি বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই সম্মেলন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে করা হয়েছে। আমরা নিজেদের গঠনতন্ত্র বর্হিভূত কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে রাজি নয়। এজন্য আমরা সম্মেলনে যাইনি।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য আ জ ম নাছির উদ্দীনকে কল করা হয়েছিল। তিনি একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে থাকায় কথা বলতে পারেননি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের শেষদিকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সম্মেলন শুরু হলে বিরোধ চাঙ্গা হয়। নেতারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ওই বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে নগরীর ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ। সেই সম্মেলন নিয়ে সংঘাত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্র থেকে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তৃণমূলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে পরস্পর বিরোধী দুটি ধারার বিরোধ আরও জোরালো হয়। দুটি ধারার একটির নেতৃত্বে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন আছেন। আরেকটি ধারা প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মহিউদ্দিনপুত্র শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উভয়পক্ষকে ‘এক রাখার’ চেষ্টা করেন মাঝে মাঝে।
ইউনিট সম্মেলনের শুরু থেকেই মহিউদ্দিনের অনুসারীরা অভিযোগ করে আসছিলেন, মাহতাব-নাছিরের একক কর্তৃত্ব ও ইচ্ছায় তৃণমূলে সম্মেলন হচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিটে মহিউদ্দিন অনুসারী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কৌশলে সদস্য করা হয়নি। তাদের বাদ দিয়েই সম্মেলন করে এক নেতার অনুসারীদের মাধ্যমে কমিটি করে ফেলাহয়েছে।
এ অবস্থায় ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিরোধ নিরসনে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্র থেকে পাঁচ সদস্যের একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। কমিটির সদস্যরা হলেন- নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর কমিটির সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং সহ সভাপতি নঈমউদ্দিন চৌধুরী ও জহিরুল আলম দোভাষ।
রিভিউ কমিটি কেন্দ্রের অনুমতিক্রমে ১৫ সাংগঠনিক থানার জন্য নগর আওয়ামী লীগের একজন করে নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে ১৫টি সাংগঠনিক টিম গঠন করে। তাদের ইউনিট সম্মেলন নিয়ে অভিযোগ যাচাইবাছাইপূর্বক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের সম্মেলন সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিরোধ মেটেনি। ফলে ইউনিট সম্মেলন শেষ হলেও ওয়ার্ড এবং থানাগুলো ঝুলে আছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের সম্মেলন সম্পন্ন হয়। কেন্দ্রের নির্দেশে সম্মেলনের কথা বলা হলেও মাহতাব-নাছিরের বিরোধীরা হঠাৎ ওয়ার্ডে সম্মেলন নিয়ে আপত্তি জানান। এই প্রেক্ষাপটে সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যান নেতারা। ২০০৫ সালে সর্বশেষ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছিল। এতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কাজী ইনামুল হক দানু।
দানু মারা যাবার পর ২০১৩ সালে কেন্দ্র থেকে একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়, যাতে মহিউদ্দিনকে সভাপতি ও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর প্রথম সহ-সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম