ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কার পেলেন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৫০ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৫৬
সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল গ্রহণ করেছেন ‘দি ফেলিক্স-হুফুয়ার্ট বোয়েনি ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার’। বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পুরস্কারটির অর্থমূল্য দেড় লাখ মার্কিন ডলার গ্রহণ করেছেন, লাভ করেছেন একটি স্বর্ণপদক। জয় করেছেন ইউনেসকোর ডিরেক্টর জেনারেলের স্বাক্ষরসহ সার্টিফিকেট ।
মার্কেলকে ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার প্রদান করা বিচারকদের প্রধান ডা. ডেনিস মুকওয়েইগে, একজন অত্যন্ত বিখ্যাত কঙ্গোর স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও একজন বিশ্বখ্যাত খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক, পানজি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৮ সালে বিশ্বখ্যাত এই পাদ্রী ও চিকিৎসক যৌথভাবে যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাতের যৌননির্যাতনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বিপক্ষে তার অবিশ্বাস্য ও অনবদ্য কমের স্বীকৃতি হিসেবে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ জয় করেছেন। আর কোনো খ্রিস্টান ধর্মযাজকই নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করতে পারেননি, ডা. ডেনিস মুকওয়েইগের মতো।
ইউনেসকোতে লেখা আছে তার মুখবন্ধ— ‘আমাদের সব বিচারকের হৃদয়ই জার্মানির ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সাহসী, নির্ভীক ও বীরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো প্রতি, যেটি তিনি ২০১৫ সালে গ্রহণ করেছেন। মার্কেল তখন তার জার্মানিতে আশ্রয় দিয়েছেন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি শরণার্থীকে। বরাবরই যৌন নিযাতনকে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য অভিশাপ দিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর। বিশ্বজুড়েই তিনি পরিচিত হয়েছেন নারীদের অধিকারের একজন রক্ষক।’
ডা. ডেনিস মুকওয়েইগ আরও জানিয়েছেন, কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বিচারকমণ্ডলী প্রদান করেছেন সম্মানজনক উল্লেখযোগ্য পদকটি (অনারেবল মেনশন প্রাইজ) জুলিয়েন লিসেঙ্গইকে। তিনি যুদ্ধকালীন যৌননির্যাতনের বিপক্ষে কাজ করে বিশ্বজুড়ে সম্মানিত কঙ্গোর নারী মানবাধিকারকমী (অ্যামোনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পদকজয়ী)। তিনি আমাদের পদকটি জয় করেছেন যারা যৌন নির্যাতনের শিকার সেই নারীদের প্রতি তার অঙ্গীকার ও কর্মের স্বীকৃতিতে। তিনি নিজের দি ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো বা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোর উত্তর কিভুতে তার কাজের জন্য অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করেছেন।’
জার্মান ভাষায় অ্যাঙ্গিলা ডোহোথিয়া মার্কেল নামের এই নারীটির বয়স এখন ৬৯। তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ২০০৫ থেকে ২০২১ টানা ১৬টি বছর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়ভাবে, একচেটিয়া, কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি না করে জার্মানি নামের বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিকে শাসন করে। এরপর আর থাকবেন না বলে চলে গিয়েছেন রাজনীতির মাঠ থেকে প্রবল গৌরবে। জার্মান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী রাজনীতিবিদ এই মেয়েটিই। গৌরবময় রাজনৈতিক জীবনে ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত জার্মানির বিরোধী দলের নেতা ছিলেন পার্লামেন্টে। ২০০২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তার দলের প্রধান। এভাবে একে, একে সব দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছেন নতুন এক জার্মানি উপহার দেওয়া অ্যাঙ্গেলা মার্কেল।
জার্মানিকে শাসন করার সময় প্রতিবারই মূল কেন্দ্র হিসেবে এ মানুষটি এসেছেন ইউরোপিয় ইউনিয়নে। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর নারী। অথচ তার জীবন গল্পে মোড়া। অ্যাঙ্গেলা মার্কেল জন্মগ্রহণ করেছেন পশ্চিম জার্মানির হামবুর্গে, একটি শিশু হিসেবে আগমন পূর্ব জার্মানিতে। তখন তার বাবা হস্ট কাস্টনার একজন লুথেয়ারিয়ান পাদ্রী, পেয়ালেবেয়ার্গে একজন যাজকের চাকরিটি লাভ করলেন। তার জীবনের সবচেয়ে বড় শান্তি এই, নিজের মেয়েকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে টানা ছয় বছর দেখে যেতে পেরেছেন। ফাদার কস্টনার একজন প্রোটেস্টান্ট ধর্মতত্ববিদও ছিলেন। অথচ একজন পুলিশ অফিসারের ছেলে। আর তিনি কাস্টনার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীতে কমরত ছিলেন। তবে সে সময় সম্পর্কে সামান্যই জানা যায়। মোটে ১৯ বছর বয়সে তিনি যুদ্ধবন্দী হয়েছেন। হাই স্কুলের জীবনে হিটলার ইয়ুথের একজন সদস্য ছিলেন। ছিলেন একটি ট্রুপের প্রধানও। ১৯৪৮ সাল থেকে থিওলজি বা খ্রিস্টান ধর্মতত্ব পড়তে শুরু করেন কস্টনার। প্রথমে পড়েছেন হাইডেলবার্গে, পরে হামবুর্গে। এখানেই তার সঙ্গে হ্যালেন্ডে ইয়েঞ্জ’র সঙ্গে পরিচয় ও পরে বিয়ে। এই নারী একজন ইংরেজি ও লাতিন ভাষার শিক্ষক। যার বাবা ভিলি ইয়েঞ্জ একজন রাজনীতিবিদ, তাদের ডানসেই নামের একটি মুক্ত দেশ ছিল।
১৯৫৭ সাল থেকে টেম্পলিন নামের একটি শহরে বাস পাকাপাকিভাবে শুরু করেন ফাদার কস্টনার। এখানে যাজকীয় রাজ্যের জেনারেল সুপারিনটেনডেন্ট আলব্রেইট শুনহেয়ারের অনুরোধে ধর্মীয় শিক্ষা অফিসারের (রিলিজিয়াস এডুকেশন অফিসার) পদে চাকরি নেন। একটি উন্নয়নমূলক পদ। এখানেই তার এই মেয়েটি ১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। বাবা একজন ধর্মীয় নেতা ও আদর্শবাদী হিসেবে মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র, যিনি কোনোদিন গির্জার সরকার ও সোশ্যালিস্ট পার্টির বিরোধিতা করেননি। একজন অগ্রসরমুখী মানুষ ছিলেন ফাদার কস্টনার। তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছিল তাই। ‘রেড কস্টনার’ নামে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। দীর্ঘকাল প্যাস্টোরিয়াল কলেজের পরিচালক ছিলেন। এখানেও অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। তার কলেজটি ‘দি ইভানজলিক্যাল চার্চ ইন বালিন-ব্রানডেনবর্গ’র সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই ট্রাম্পলিনে সব খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিককে তাদের শিক্ষা, অধ্যাত্নবাদ ও প্রশিক্ষণ জীবনের অংশ হিসেবে থাকতে হয় ও তাদের দ্বিতীয় ধর্মতাত্বিক এবং আধ্যাত্নিক পরীক্ষায় এখানে বসতে হয় ও ‘ভিকার’ বা ‘বদলী যাজক’ হিসেবে কাজ করতে হয়। ট্রাম্পলিনের যাকজীয় কলেজটি ফাদার কস্টনারের তিন মেয়ের কারোরই স্বাভাবিক পড়ালেখা আটকায়নি। পূর্ব জার্মানির দি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের একেবারে প্রথম দিকের সদস্য ছিলেন তাদের বাবা। যার মেয়ে মিরাকেল, যাকে সারাবিশ্ব ডাকে মার্কেল, ‘কোয়ান্টাম রয়াসন’-এ ‘পিএইচডি’ ১৯৮৬; একজন গবেষণা রসায়ন বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন।
১৯৮৯ সালে ঘুম থেকে জাগানোর বিপ্লবের সময়কালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন মার্কেল। পূর্ব জামানির প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারের উপ-মুখপাত্র ছিলেন। এরপর থেকে টানা সরকারি দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন তিনি। ছিলেন হেলমুট কোহেলের মন্ত্রিসভার ১৯৯১ সালে নারী ও তরুণ মন্ত্রী, ১৯৯৪ সালে হয়েছেন পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষা এবং পরমাণু নিরাপত্তা মন্ত্রী। এরপর ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রীয় নির্বাচনে প্রথম জার্মানির নারী চ্যান্সেলর। ২০১১ সালে দি ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। নিজের দেশের স্বাস্থ্যসেবাখাতকে পুর্ণজাগরণ করেছেন। ইউরোপে শরনার্থী বা অভিবাসীদের সংকটকে দারুণভাবে মোকাবেলা করেছেন। আর সেজন্যই তার ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কার জয়। একেবারেই সাধারণ জীবন কাটান এই জার্মান প্রধান।
আইভরি কোস্টের প্রথম প্রেসিডেন্টের নামে প্রচলিত ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কার গ্রহণের সময় জার্মানির সাবেক নারী চ্যান্সেলর বলেছেন, ‘শ্রদ্ধাভরে, সংরক্ষণের সঙ্গে ও মানবাধিকারকে আমাদের সকলের জন্য জানিয়ে আমি এই পুরস্কার গ্রহণ করছি। আমরা আমাদের অভিবাসন নীতিতে এই মূল বিষয়গুলোকে প্রয়োজনীয় মনে করে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম। এই কাজটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র এই কারণে, অনেক মানুষ এই মাটিতে তাদের হাতগুলো মুছেছেন।’
১৯৯৩ সালে মারা যাওয়া আইভারিয়ান প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স-হুফুয়াট বোয়েনির নামে এরপর তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করেছেন। ২০১৫ ও পরের বছর জার্মানির এই শাসক ১ কোটি ২০ লাখের বেশি শরণার্থীকে তার দেশে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি সিরিয়ার যুদ্ধে সব হারানোদের বিষয়ে সবসময় উচ্চকণ্ঠ।
তাকে এই পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠানে এসেছেন আইভরি কোস্টের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলাসান উয়েঠেরা। বলেছেন, ‘জনগণের মতামতের সঙ্গে যুদ্ধ করেই যুদ্ধ ও সহিংসতায় আক্রান্ত স্থানগুলো থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আপনি জার্মানির সীমান্তগুলোকে খুলে দিয়েছিলেন। আপনি সব বিশ্বনেতাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, সব মানবিক বিষয়ে তাদের একতা ও সংহতির দায়িত্বগুলো রয়েছে এবং সেগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে।’
তার সঙ্গে একই মঞ্চে এসেছেন তার দেশের সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে বিরোধী দলের নেতা হেনরি কোনান বেইডিয়ে ও লরোন ব্যাকবো। তারা ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর প্রথম একত্রে মানুষের সামনে এলেন। মঞ্চে আরও ছিলেন সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সাল, গায়ানা-বিসাওয়ের প্রেসিডেন্ট ও পশ্চিম আফ্রিকান দেশগুলোর অথনৈতিক সমাজের চেয়ারম্যান উমারো সিসোকো ইমবালো এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং চাদের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মাউনা ফাকি মাহামাত।
১৯৮৯ সাল থেকে চালু হওয়া পুরস্কারটি প্রদানের জন্য এবার প্রায় ২ হাজার আমন্ত্রিত অতিথি এসেছেন। ‘ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার’ আগে আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী ও কালো মানুষের সংগ্রামের প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলনের নেতা ও আরব জাতীয়তাবাদের প্রতীক ইয়াসির আরাফাত, ইসরায়েলের শান্তি আলোচনার অগ্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন, ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও বাম পুর্ণজাগরণের অন্যতম নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা দ্যা সিলভা এবং ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলদ জয় করেছেন।
সারাবাংলা/একে