গ্রামগঞ্জেও ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের ছড়াছড়ি, গ্রেফতার ৩
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:০৭ | আপডেট: ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:২১
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পর এবার পৌরসভা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সার্ভারে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ দাখিল করে পাসপোর্টের আবেদনের পর জেলা পুলিশের তদন্তে এই জালিয়াতির তথ্য মিলেছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ জালিয়াত চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ জানিয়েছেন, বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নে যেসব ভুয়া জন্ম নিবন্ধন শনাক্ত হয়েছে, তার অধিকাংশই মায়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের। তাদের চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট পাইয়ে দিচ্ছে জালিয়াত চক্র। জালিয়াতির মধ্য দিয়ে পাঁচশ’রও বেশি রোহিঙ্গা এরইমধ্যে জন্ম নিবন্ধন করেছে বলে তাদের কাছে তথ্য আছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ডে শতাধিক ভুয়া জন্ম নিবন্ধন নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যেই পৌরসভা-ইউনিয়নেও একই জালিয়াতির তথ্য দিলো জেলা পুলিশ। তবে জালিয়াত চক্র হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে না কি মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে আইডি-পাসওয়ার্ড নিয়ে সার্ভারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নুর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে যে প্রক্রিয়ায় অবৈধ জন্ম নিবন্ধনগুলো হয়েছে, এখানেও একই প্রক্রিয়ায় হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। সার্ভার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে হতে পারে, তবে সেটি আমরা এখনও ক্লিয়ার না। এখানে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে ভালো ধারণা আছে, এমন কেউ জড়িত। সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট শহরের বিষয়টি তদন্ত করছে। আমরাও তদন্ত শুরু করেছি।’
গ্রেফতার তিনজন হলেন মো. আরিফ (২৭), মো. জসিম উদ্দিন (৩০) এবং মো. তারেক (২৯)। এদের মধ্যে আরিফ ও জসিমের বাড়ি কক্সবাজার এবং তারেকের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়।
জেলা পুলিশ জানায়, আরিফকে চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েত বাজার এবং জসিম ও তারেককে ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে।
চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারি পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়নের ঠিকানা ব্যবহার করে কয়েকটি পাসপোর্টের আবেদন গত এক মাসে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় জমা পড়ে। বিশেষ শাখার কর্মকর্তারা ঠিকানা যাচাই করতে গিয়ে দেখেন, ঠিকানা ও বাবা-মায়ের নাম সঠিক থাকলেও আবেদনকারীর তথ্য সম্পূর্ণ ভুয়া। বিষয়টি পুলিশ সুপারের নজরে আনা হলে তিনি তদন্তের জন্য গোয়েন্দা শাখাকে নির্দেশ দেন।
গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তে নেমে প্রথমে পাসপোর্টের আবেদনকারী আফরোজা আক্তারের ভাই পরিচয় দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুলিশের বিশেষ শাখায় জমা দিতে আসা আরিফকে তার অবস্থান শনাক্ত করে আটক করে। আফরোজা আক্তারের বাবার নাম ‘আবুল হাসেম’, ঠিকানা- চন্দনাইশ পৌরসভার দক্ষিণ গাছবাড়িয়া উল্লেখ করে পাসপোর্টের আবেদন করা হয়েছিল।
কিন্তু বিশেষ শাখা কর্মকর্তারা সেই ঠিকানায় আফরোজা এবং তার ভাই আরিফ নামে কাউকে পাননি। এরপর আরিফকে আটক করা হয়।
গোয়েন্দা পরিদর্শক নুর আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আরিফের মোবাইল আমরা জব্দ করি। সেখানে আরও ৫-৭টি পিডিএফ করা জন্ম নিবন্ধনের তথ্যসহ ফরম পাই। সেগুলোতে চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলার বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২-১টি জন্ম নিবন্ধন সনদ দাখিল করে এনআইডি এবং পাসপোর্টও নেওয়া হয়েছে বলে আরিফ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।’
‘আরিফ আমাদের জানায়, জসিম ও তারেক মূলত অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধনের জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করেন। তাদের তথ্য আরিফকে তারা সরবরাহ করেন। আরিফ সেগুলো পিডিএফ ফরম্যাটে লিপিবদ্ধ করে পাঠিয়ে দেন জনৈক মোস্তফার কাছে। মোস্তফা জন্ম নিবন্ধনের সার্ভারে নিজে অথবা অন্য কারও মাধ্যমে ইনপুট দিয়ে আরিফের হোয়াটস অ্যাপে পিডিএফ ফরম্যাটে সনদ পাঠিয়ে দেয়। আরিফ শুধু সেটা কালার প্রিন্ট করে জসিম ও তারেকের হাতে তুলে দেয়।’
মোস্তফার বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় এবং সে ‘টেকনিক্যাল এক্সপার্ট’ বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা নুর আহমদ।
পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ জানান, চন্দনাইশের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও দোহাজারি পৌরসভার ঠিকানা ব্যবহার করে অন্তঃত ৩০০ রোহিঙ্গাকে জন্ম নিবন্ধন করার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের সচিব, জন্ম নিবন্ধন সহকারী ও জনপ্রতিনিধির স্বাক্ষর জাল করে সনদ নেয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
‘এখানে দুটি জালিয়াত চক্র আছে। একটি চক্র চট্টগ্রামে এবং আরেকটি কক্সবাজারে সক্রিয়। দুই চক্র নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে অবৈধ জন্ম নিবন্ধনের গ্রাহক বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে। এরপর জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়। যেসব রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়েছে, তাদের শনাক্তের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের এবং চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হবে। তবে অবৈধ জন্ম নিবন্ধনগুলো ব্লক করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা এনআইডি ও পাসপোর্ট না পায়’- বলেন এসপি
গত ৮ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নগরীর ৬টি ওয়ার্ডে ৭৯৭টি ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের প্রমাণ পাবার তথ্য দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা, ১৪ নম্বর লালখান বাজার, ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা এবং ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে এসব জালিয়াতির ঘটনায় তিনটি মামলা ও একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে।
নগরীর খুলশী থানায় দু’টি ও হালিশহর থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলা তদন্ত করছে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে জয়নাল আবেদিন নামে নির্বাচন কমিশন থেকে বরখাস্ত হওয়া এক কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাকে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার অভিযোগে ২০১৯ সালে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এর আগে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও এনআইডি পাইয়ে দেয়া নিয়ে প্রথম জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন হয়। ২০১৪ সালে মায়ানমার থেকে আসা রমজান বিবি নামে এক নারী ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে তৈরি করেন জাল এনআইডি। স্মার্ট কার্ড নিতে চট্টগ্রামের জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে সন্দেহবশত তাকে জেরা করা হয়। দেখা যায়, তার জন্মসনদ জাল। অথচ সেই জন্মসনদ ব্যবহার করে তৈরি করা পরিচয়পত্রের তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত ছিল।
এ ঘটনার পর নগরীর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন, এনআইডি উইংয়ের কর্মী শাহনূর মিয়া, অস্থায়ী কর্মী মোস্তফা ফারুক, মো. শাহীন, মো. জাহিদ হাসান এবং পাভেল বড়ুয়াসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছিল কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তাদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়।
জয়নাল আবেদিনের কাছ থেকে পুলিশ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছিল। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে প্রকাশ হয়, ইসি’র হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ ব্যবহার করে ২০১৫ থেকে ২১০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের এনআইডি পাইয়ে দেয়া হয়। এদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা।
দুদক ১১ জনের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করেছিল, যে মামলায় চট্টগ্রাম জেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম, অফিস সহায়ক রাসেল বড়ুয়া এবং টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোস্তাফা ফারুককে আসামি করা হয়েছিল।
সারাবাংলা/আরডি/একে