এনআইডি নম্বরটিই হতে হবে টিআইএন: গাজী গোলাম মূর্তজা
১১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০৫ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৫৯
ঢাকা: ২০২১-২২ করবর্ষে ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন গাজী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী গোলাম মূর্তজা পাপ্পা। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেরা ট্যাক্স কার্ড সম্মাননা গ্রহণ করেন তিনি।
গাজী গোলাম মূর্তজা পাপ্পা সেরা করদাতা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সারাবাংলার সঙ্গে। পাশাপাশি কথা বলেছেন কর ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়েও। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার জয়েন্ট নিউজ এডিটর কবীর আলমগীর।
সারাবাংলা: ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে শীর্ষ ৫ করদাতার একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই স্বীকৃতির বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
গাজী গোলাম মূর্তজা: এক কথায় বলতে গেলে বিষয়টি আনন্দের। আমার মনে আছে, ১৯৯৫ সালের দিকে গাজী গ্রুপ থেকে একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে স্লোগান ছিল ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভাবতে ভালোই লাগছে।’ এখন দেখছি, ‘দেশ এগিয়ে গেছে, দেখতে ভালোই লাগছে।’ আমরা কর দিচ্ছি। সেই করের টাকায় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। আমার টাকায় গড়ে উঠছে আমার দেশ। এটি আনন্দেরই শুধু নয়, তৃপ্তিরও। কারণ বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। দেশের ১৬ কোটি মানুষ এই দেশের মালিক। আমি একটি দেশের মালিকানা গ্রহণ করব, কিন্তু সেই দেশের উন্নয়নে আমার কোনো অংশীদারিত্ব থাকবে না তা তো হতে পারে না। হওয়া উচিতও না।
সারাবাংলা: পাবলিক সার্ভিসখাতের কোনো কোনো জায়গা যেমন ব্যাংক-বীমা, পানি-বিদ্যুৎ, পাসপোর্ট প্রভৃতিতে সেবা নিতে গেলে অনেক সময় টিআইএন চাওয়া হয়। কিন্তু ওই সব সেবাখাতগুলোতে এখনও ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক নয়। এর ফলে আমরা শুধু টিআইএন দিয়েই সেবাগুলো নিচ্ছি। ফলে দেখা যাচ্ছে নিবন্ধিত টিআইএনধারীর দুই তৃতীয়াংশ এখনও করের আওতার বাইরে। কীভাবে করদাতার সংখ্যা আরও বাড়ানো যেতে পারে?
গাজী গোলাম মূর্তজা: এক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ওই সব দেশে যখনই কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গে তার একটি সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর দেওয়া হয়। যে নম্বরটি তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত বহাল থাকে। ওই নম্বর দিয়েই সে আয়কর দিতে পারে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারে, প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা পায়, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা সবকিছুই সে পায়।
আমার কথা হলো, বাংলাদেশে যখন কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করছে; আমরা তাকে যে জন্ম নিবন্ধন নম্বর দিচ্ছি তা দৃশ্যত খুব বেশি কাজে লাগছে না। শিশুদের যদি সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নম্বর কিংবা টিআইএন দেওয়া হয় তাহলে সে যখন আয় করবে তখন সে ওই নম্বর দিয়েই আয়কর পরিশোধ করতে পারবে। বিষয়টি হলো, একটি শিশু জন্মের পরপরই আয়কর নিবন্ধনের আওতায় চলে এলো বা যখন সে রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক কোনো সুযোগ-সুবিধার আবেদন করবে সে ওই নম্বর দিয়েই করতে পারবে । আমাদের দেশে ইউনিভার্সেল বলে কোনো নম্বর নেই। যা আছে তা মাল্টিফাংশনাল, মাল্টিপল নম্বর। তার জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও টিআই নাম্বার আলাদা- এই তিনটা যখন আলাদা তখনই কনফিউশন থেকে যায়। ওয়ান নম্বর ইজ ইউনিভার্সেল নম্বর- এটি নিশ্চিত করা গেলে আয়কর আদায়ের পরিমাণ বাড়বে বলে মনে করি।
সারাবাংলা: আমরা যে আয়কর দিচ্ছি তা ব্যয় হচ্ছে উন্নয়ন বাজেটে। যার অধিকাংশই অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এনবিআরের এই আয় যদি শিক্ষা, সেবা, বেকারভাতা প্রভৃতির মত সামাজিক নিরাপত্তাখাতে ব্যবহার করা হয় তাহলে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাটি আরও পরিষ্কার হয়। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, এনবিআরকে কীভাবে সামাজিক নিরাপত্তার জায়গায় আরও বেশি সম্পৃক্ত করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
গাজী গোলাম মূর্তজা: আয়কর দেওয়া একটি নাগরিক দায়িত্ব। এটি নিছক দায়িত্ব নয়, আইনগতভাবেও বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। এই বিষয়টি নাগরিকদের উপলব্ধি করাতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা এটি উপলব্ধি করাতে পারব, ততক্ষণে কর নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্র বাড়বে না। ৫/৭ ভাগ মানুষ আয়করদাতা। এক অর্থে তারা দেশের বাকী ৯৩ শতাংশ মানুষের দায়িত্ব নিচ্ছে। করদাতা ও সেবাগ্রহীতার এই সংখ্যাটি কিন্তু জিওম্যাট্রিক নয়। আমরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেব কিন্তু আমাদেরও বুঝতে হবে ঘরের বাইরেও তার আরেকটি জগত আছে, আরেকটি দায়িত্ব আছে। এই যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রাস্তাঘাট, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেতু-কালভার্ট এগুলো তো জাদুকরি ব্যাপার নয়। এগুলো করতেও তো করের টাকা খরচ হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সেবাখাতই তো ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হয় । আমরা ভর্তুকি দিয়ে যে সেবা নিচ্ছি, সেটি পৃথিবীর কোথাও হয় না। চিন্তা করে দেখুন, আমাদের অ্যানার্জিখাত বিপুল ভর্তুকিতে চলছে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এমনকি কৃষিও চলছে ভর্তুকিতে। কৃষকের সার, কীটনাশক- এগুলো ভর্তুকি থেকে আসছে। এই টাকাগুলো তো কোনো জাদুর কাঠির মাধ্যমে আসছে না। এগুলো ট্যাক্সের টাকায় হচ্ছে, কেউ না কেউ এই ভার বহন করছেন। যখন দেশের কোনো নাগরিক উপলব্ধি করবে ট্যাক্স আমার জন্য মঙ্গলের তখনই ট্যাক্সের আওতা বাড়বে, তা হবে সবার জন্য মঙ্গলকর। আরেকটি বিষয় হলো- আমাদের ট্যাক্স লিটারেসি বাড়াতে হবে। বিদেশের পাঠ্যপুস্তকে ট্যাক্স অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু আমার জানামতে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এগুলো নেই।
সারাবাংলা: আমাদের কর আহরণ ও কর কার্যক্রমের নজর শহরকেন্দ্রিক। আহরণ করা করের ৭৪ শতাংশ আসছে ঢাকা থেকে, বাকি ১৬ শতাংশ আসছে চট্টগ্রাম থেকে। কর কার্যক্রমের বিষয়টি শুধু শহরকেন্দ্রিক না করে প্রত্যন্ত জনপদেও কীভাবে বিস্তৃত করা যেতে পারে কিংবা এক্ষেত্রে আমাদের পলিসি কী হতে পারে?
গাজী গোলাম মূর্তজা: আমি সরকারি সেবা নিতে যাচ্ছি। ব্যাংকে যাচ্ছি, ব্যাংকের বিল নিচ্ছি, মোবাইল ফোন কিনছি- এরকম জায়গাতে টিআইএন ও ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করতে হবে। কেননা আমি সুযোগ-সুবিধা ঠিকই নিচ্ছি কিন্তু টিআইএন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলে বছর শেষে অনেকেই তার টিআইএন ভুলে যাচ্ছেন। কিংবা আমাকে বছর শেষে ট্যাক্স দিতে হবে সেটিও ভুলে যাচ্ছি। আমি সরকারের সেবা নিচ্ছি, তার মানে সেগুলো ট্যাক্স পেইড সেবা। আমি সরকারকে বন্ধু ভাবছি কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমার যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন করছি না।
সারাবাংলা: এনবিআর কর আদায়ের ক্ষেত্রে কখনও কখনও লক্ষ্যমাত্রা হয়ত পূরণ করছে। দেখা গেল, এ বছর ৪ হাজার কোটি টাকা কর আদায় হলো। কিন্তু এই সংখ্যা যদি ১২ হাজার কোটি টাকা কিংবা ৩০ হাজার কোটি টাকা হয় তাহলে পদ্মা সেতুর মতো আরেকটি সেতু নির্মাণের সাহস আমরা দেখাতে পারি। যারা কর ফাঁকি দিচ্ছেন কিংবা যারা কর দিচ্ছেন না তাদের মনোভাব পরিবর্তনের উপায় কী হতে পারে?
গাজী গোলাম মূর্তজা: একটি কথা হলো, আমাদের যে এনআইডি নম্বর সেটিই টিআইএন হওয়া উচিত। তাহলে সেটি হবে ইউনিভার্সেল নম্বর। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, চাকরি-পেনশন সবকিছুই এই নম্বরের মাধ্যমে হতে পারে। আমাদের একটি ইউনিভার্সেল নম্বর থাকতে হবে। এনআইডি নম্বরটি টিআইএন করলে এতে ১৬ কোটি মানুষকে কর নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হবে। সেটির দিকে আবশ্যিকভাবে নজর দিতে হবে।
সারাবাংলা: সেবাখাতগুলোর অধিকাংশতেই ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া এসেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়গুলো উৎরে গিয়ে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিষয়টি স্লোগান হিসেবে নিচ্ছি। এক্ষেত্রে এনবিআরকে আরও বেশি ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর আর বেশি স্মার্ট কীভাবে করা যায়?
গাজী গোলাম মূর্তজা: আমরা তো জানি ১৪ এপ্রিল আমাদের বাংলা নববর্ষ কিংবা ৩১ ডিসেম্বর আমাদের বছরের শেষ দিন। ওইরকমভাবে রিটার্ন দাখিলের জন্য নির্ধারিত যে দিনক্ষণ সে বিষয়ে আরও বেশি প্রচার দরকার। সমগ্র জাতি যেন জানতে পারে নির্দিষ্ট তারিখে আমাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। সেই উপলব্ধির জায়গাটি জোরালো করতে হবে। রিটার্ন যদি জিরো বা জিরো ইনকাম হয় তাহলেও রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এক্ষেত্রে এনালগের পাশাপাশি পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে হবে। কেউ যদি এনালগ সিস্টেমে অবলম্বন করতে চায় সেও করতে পারে। আবার কেউ ডিজিটালি করতে চাইলেও পারবে। শুধু রিটার্ন দাখিল নয়, আমার যে টিআইএন আছে তার ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটও নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা, করদাতাকে আইনি বাধ্যবাধ্যকতার পাশাপাশি তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট না থাকলে রাষ্ট্রীয় যে সব সেবা বা সুবিধা পাওয়ার কথা সেগুলো যদি বন্ধ করে দিই তাহলে করদাতা তার কর পরিশোধে বাধ্য হবে। এভাবে রিটার্ন দিতে দিতে সত্যিকার অর্থে রিটার্ন দাখিলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
সারাবাংলা: এরকম অভিযোগ প্রায়শ শোনা যায় যে, সরকার ভ্যাটের আওতা না বাড়িয়ে খাতে-উপখাতে নানারকম করারোপ করা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় করকে বোঝা মনে করছেন। আপনি কি মনে করেন এতে ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন?
গাজী গোলাম মূর্তজা: শুধু করের আওতা বাড়ানো বা কর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় এখানে নেই। আমি মনে করি, আমাদের এখানে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করের যে মাত্রা তা আন্তর্জাতিকমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মূল বিবেচ্য হতে পারে আমি ব্যবসা করতে গিয়ে কতটুকু ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। আমি যদি পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করতে পারি, উপার্জন করতে পারি তাহলে কর যাই-ই হোক না কেন অভিযোগ কিন্তু থাকবে না। ধরুন আমার একটি দোকান আছে বা বাজারে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু দোকানের সামনে যে রাস্তাটি আছে তা যদি ক্রেতাদের চলাচলবান্ধব না হয়, তাহলে আমি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। সেখানে হয়ত আমার কাস্টমার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আসবে না। আমার কোনো পণ্য যদি দূর এলাকায় পৌঁছে দিতে না পারি, দেখা গেল পণ্যপরিবহনের রাস্তাটি উপযুক্ত নয়, তাহলে তো হবে না। ব্যবসার সঙ্গে ট্যাক্সের সম্পর্ক যেমন আছে, ব্যবসার সঙ্গে ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ও আছে। তবে ব্যক্তিপর্যায় হোক কিংবা ব্যবসায়িক পর্যায়ে , আমাকে ট্যাক্স দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আর ট্যাক্স দিতে না পারলে আমাদের ঋণও কমবে না। কেননা আন্তর্জাতিক ঋণের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও আছে। ঋণ মানেই শর্তারোপ, ঋণ মানেই ষড়যন্ত্র। আমরা যদি নিজেদের টাকায় দেশের উন্নয়ন করতে পারি তাহলে সে সেই ষড়যন্ত্র দেশে ঢুকতে পারবে না।
সারাবাংলা: অনেকেই কর ফাঁকি দিচ্ছেন কিংবা কর দেওয়ার বেলায় কৌশল অবলম্বন করছেন? এতে প্রকৃত করদাতারা নিরুৎসাহিত হন কিনা?
গাজী গোলাম মূর্তজা: সংবিধান অনুযায়ী আপনি কিন্তু দেশের মালিক। সুতরাং কেউ কর ফাঁকি দিলে সে কিন্তু নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছেন। এই ধরনের চর্চার বিষয়গুলো নিরুৎসাহিত করে তাকে আইনি বাধ্যবাধকতা ও আইনি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কেননা করের টাকায় উন্নয়ন হচ্ছে। আপনি যদি কর না দেন তাহলে নিজেকেই উন্নয়নবঞ্চিত করছেন। আপনি যত বেশি কর দেবেন ততই উন্নয়ন হবে, ব্যবসায়িক পরিবেশও বাড়বে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে, ব্রিজ-কালভার্ট হবে, রাস্তাঘাট হবে। কেউ কর দেওয়ার বেলায় আইনি এখতিয়ারের মধ্য থেকেই কৌশল নিতে পারে, সেটিও আইন অনুযায়ী হতে হবে। আপনার কর দেওয়ার প্রকৃত যে অংশ সেটি অবশ্যই দিতে হবে। প্রকৃত কর ভ্যালু থেকে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
আমরা সরকারকে যতই জনবান্ধব বা ব্যবসাবান্ধব বলি না কেন, সরকারের অন্যান্য অর্গানগুলোকেও জনবান্ধব হতে হবে। অনেকের কাছে এনবিআর আতঙ্কের বিষয়। কিন্তু এই আতঙ্কের জায়গায় না থেকে এনবিআরের ভূমিকা হতে হবে বন্ধুর মতো। এটি করতে না পারলে পরিপূর্ণভাবে ট্যাক্স আসবে না। এনবিআরকে হতে হবে শিক্ষকের মতো, মমতাময়ী মায়ের মতো। এই মেসেজটি এনবিআর জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। কারণ আমরা কাউকে ভয় পেলে তার কাছ থেকে দূরে থাকব, আর দূরে থাকার অর্থ হলো ট্যাক্স না দেওয়া। অবশ্যই এনবিআরকে আস্থার জায়গায় নিতে হবে।
সারাবাংলা: এনবিআরকে ভয় না পেয়ে আস্থার জায়গায় আমরা কীভাবে নিতে পারি?
গাজী গোলাম মূর্তজা: আস্থার জায়গায় অবশ্যই নিতে হবে। কারণ আমরা সরকারকে জনবান্ধব মনে করলে এনবিআরকেও ওই চোখে দেখতে হবে। এনবিআর একটি মিডিয়াম ও গাইডলাইন আমাদের জন্য। আমরা যে টাকা দিচ্ছি তা কিন্তু এনবিআরকে দিচ্ছি না, সরকারকে দিচ্ছি। আর সরকার মানেই আমি-আপনি সর্বোপরি জনগণ। আমার করের টাকায় আমার উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা সেবাগুলো নিচ্ছি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা ধরুন। সেখানে আমরা কম টাকায় থাকা-খাওয়া, পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছি। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত কম টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা যায় না। তার মানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কি উন্নয়ন হচ্ছে না, শিক্ষকের বেতন হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। তা হচ্ছে করের টাকায়, আমার-আপনার টাকায়। আমার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অনেক সময় ধারদেনা করে আমাদের সন্তানকে বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাঠাচ্ছি। কিন্তু আমরা বুঝতে চাই না ওইরকম পড়াশোনা আমাদের দেশেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েটে হচ্ছে। করের টাকায় ভর্তুকির মাধ্যমে আমরা কিন্তু এই পড়াশোনার সুযোগটি নিতে পারছি। এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আর দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। কর দেওয়ার অর্থ হলো আপনি দেশপ্রেমের কাজটি করছেন। এটি শুধু ঈমানের অঙ্গ নয়, কর দেওয়া একইসঙ্গে আপনার নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্বও বটে।
সারাবাংলা: যারা কর দিচ্ছেন অনেকের অভিযোগ কর দেওয়া কিংবা নেওয়ার পদ্ধতি জটিল। এটি আরও সহজ করা যায় কীভাবে?
গাজী গোলাম মূর্তজা: কর দেওয়া কিংবা কর নেওয়ার সিস্টেমটি অবশ্যই জটিল। নিজের ট্যাক্স সাবমিশন যেন আমি নিজে করতে পারি সেই উদ্যোগটি দরকার। তাহলে করদাতারা কর দিতে আরও উৎসাহী হবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর দিতে গেলে আইনি পরামর্শ নেওয়া লাগে, আইজীবীর শরণাপন্ন হতে হয়। এই বিষয়টি করদাতাকে বিড়ম্বনায় ফেলতে পারে। ট্যাক্স সাবমিশন পদ্ধতিটি এনবিআরকে তাদের ওয়েবসাইটে টিউটোরিয়াল হিসেবে চালু করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নিতে পারে। এই মুহূর্তে আমাদের ট্যাক্স লেসনটা খুবই দরকার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাক্স সাবমিশন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করতে হবে। ট্যাক্স বিষয়ে মূল জানাশোনার ভিত্তিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু করতে হবে।
শহরের বাইরে গ্রাম-গঞ্জের কথা ধরুন। সেখানে ট্যাক্স দিতে গেলে আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কারণ হলো আমাদের পর্যাপ্ত ট্যাক্স লেসন নেই। শহরে যত সহজে আইনজীবী জোগাড় করা যায় গ্রাম-গঞ্জে একজন আইনজীবী পাওয়া কিন্তু সহজ নয়। গ্রামের একজন মধ্যবিত্ত কৃষক চাইলেই কি ট্যাক্স দেওয়ার জন্য হাতের নাগালে একজন আইনজীবী পাবেন? আমার প্রশ্ন হলো- আমার ট্যাক্স সাবমিশন প্রসেস কেন একজন ল’ইয়ারকে করতে হবে? নিজের ট্যাক্স নিজেকেই দিতে হবে। অনলাইনে যাব, অনলাইনে সাবমিশন করব। ভুল হবে, অডিট হবে, ভুল সংশোধনের সুযোগ পাব। এভাবেই প্রসিডিওরটা আমরা শুরু করতে পারি। যেদিন বাংলাদেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষ ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিশন করতে পারবে সেদিন বাংলাদেশে আর কোনো ঋণ থাকবে না। তখনই বাংলাদেশ হবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া।
সারাবাংলা: সারাবাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
গাজী গোলাম মূর্তজা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/একে/রমু