‘যৌন নিপীড়ক’ শিক্ষককে নিয়োগ, পূর্বসুরীদের দুষলেন রেজাউল
৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:০৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার তিন দিন পর নগরীর কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় মেয়র ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে জানিয়ে ছাত্রীদের সান্ত্বনা দেন। বার বার অভিযোগ ওঠার পরও ওই শিক্ষককে পুনর্বহালের জন্য তিনি সাবেক মেয়রদের দায়ী করেন।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরীর চকবাজারে ওই বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষক ও আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মেয়র।
যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গত রোববার (১ জানুয়ারি) সকালে কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনকে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন ছাত্রীরা। দুই ঘণ্টা বিক্ষোভের পর চসিকের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তাফা টিনু গিয়ে ওই শিক্ষককে সরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
অভিযুক্ত শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনকে প্রথমে নগরীর দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। পরদিন তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়। এ ঘটনা তদন্তে সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন পৃথক দু’টি কমিটি গঠন করেছে।
আলাউদ্দিন ২০১৩ সালে একই স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তখন মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন এম মনজুর আলম। পাঁচ বছর পর বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে ২০১৮ সালে একই বিদ্যালয়ে ফের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান আলাউদ্দিন। এ সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।
বিষয়টি উল্লেখ করে সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষককে ইতোমধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই শিক্ষকের নিয়োগ বা পুনঃনিয়োগ কিন্তু আমার আমলে হয়নি। পূর্ববর্তী মেয়র যারা ছিলেন, শিক্ষা কর্মকর্তা যারা ছিলেন তারাই নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ দেয়ার সময় এই ব্যক্তির নাকি……… এখন যা শুনছি আর কি! আসলে ওই ব্যক্তিকে নিয়োগ এখানে দেওয়া ঠিক হয়নি। যার আমলেই দিক না কেন, হয়তো বা চিন্তা করেছে সংশোধন হবে। তবে আমার আমলে কোনো ক্ষমা নেই। আমি কাউকে করুণা করি না। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে।’
শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ‘মা বাবার পরে শিক্ষকের স্থান। আমাদের কোমলমতি সন্তানেরা এখানে পড়ালেখা করতে আসে। কিছু ব্যক্তির জন্য আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। লজ্জা লাগে একজন শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতা যখন হারিয়ে যায়, পশুত্ব যখ্ন তার মধ্যে বিরাজ করে তখন সে আর মানুষ থাকে না।’
‘পাকিস্তান আমল থেকে এ বিদ্যালয়ের সুনাম আছে। যে ঘটনা হয়েছে, তার জন্য সন্তানেরা প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদের সাথে সাথেই আমার কাছে যখন খবর এসেছে, আমি কাউন্সিলর, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তাকে বললাম ওই শিক্ষককে প্রত্যাহার করে নিন। ঘটনা বিস্তারিত জানার পর আমি উনাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে বললাম।’
স্কুলের অন্য শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাকে গিয়ে বলতে পারতেন বা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলতে পারতেন যে, একজন শিক্ষক এরকম আচরণ করছেন। আপনারা বললে আমি তদন্ত করে দেখতাম। কিন্তু আপনারা সবাই চুপ ছিলেন। আমাদের মেয়েরা প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করেছে বলেই শোধরাবার সুযোগও হয়েছে।’
‘আমি কাউকে ছাড় দিই না। এটা আমার মুখের কথা নয়, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও আমি ছাড় দিই না, কথাও শুনিনা। আমি যেটা ভালো মনে করি, সেটাই আমি করি। এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি আগে কেউ অভিযোগ দিত তাহলে এ ঘটনাটা ঘটার সুযোগ হতোনা। আমি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। কমিটি তাদের তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দেবে। স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে, আমরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেব কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।’
মেয়র বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা উৎসাহ নিয়ে স্কুলে আসবে আর শিক্ষকেরা তাদের সাথে অশোভন আচরন করবে সেটা আমি মেনে নেব না। আর কোনো ছাত্রী যদি শিক্ষক দ্বারা অশোভন আচরণের শিকার হয়, স্পষ্টভাবে বলতে চাই তাদের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোনো স্কুলে আমি আর নেব না।’
‘সিটি করপোরেশন ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। চারশ’র ওপর ফোরকানিয়া মাদরাসা পরিচালনা করে। বলতে চাই, আমাদের স্কুলের যেসব শিক্ষকেরা আছেন, কারও বিরুদ্ধে যদি এরকম কোনো অভিযোগ বা ত্রুটিবিচ্যুতি পাই অথবা লোকমুখে যদি এরকম কিছু শুনতে পাই তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। সে যে-ই হোক। শিক্ষকদের শুধু নয়, নৈতিকতার প্রশ্নে কর্মচারীদেরও ছাড় দেওয়া হবে না।’ শিক্ষকরা দলাদলিতে জড়ালে বদলি নয়, সরাসরি বরখাস্ত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন মেয়র।
এদিকে, অভিযুক্ত শিক্ষককে বরখাস্তের খবর মেয়রের মুখে শুনে শিক্ষার্থীরা উল্লাস করেন। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফরোজা নাহার সারাবাংলাকে বলে, ‘উনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে শুনলাম। খুব ভালো লাগছে। নিপীড়নের কথা সবাই জানলেও ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারতো না। কাউকে ছাড়পত্র দেওয়া কিংবা কাউকে ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তিনি এসব করতেন। তাকে শাস্তি দেওয়ায় আমরা মেয়র স্যারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
এ সময় কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোমা বড়ুয়া, চকবাজার থানা ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তফা টিনুসহ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/আইসি/আরডি