Friday 03 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশ মুক্তির আগেই স্বাধীন হয়েছিল কুড়িগ্রাম

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:৩৬

ঢাকা: তখনও স্বাধীনতা লাভ করেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এরইমধ্যে ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে কুড়িগ্রামকে হানাদারমুক্ত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হলেও এ অঞ্চলে সেদিন উড়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। এই দিনে মুক্তিবাহিনীর ‘কেওয়ান এফএফ’ কোম্পানি কমান্ডার বীরপ্রতীক আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বিকেল ৪টায় কুড়িগ্রাম শহরে প্রথম প্রবেশ করে। এরপর তারা নতুন শহরের ওভার হেড পানির ট্যাংকের ওপরে (বর্তমান সদর থানার উত্তরে অবস্থিত) স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয় বিজয়বার্তা। সেদিন বিজয় মিছিলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে হাজারও মুক্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমে এসে মিলিত হয় জাতির সূর্য সন্তানদের সঙ্গে। ২৩০ দিন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের স্মৃতি প্রসঙ্গে বীরপ্রতীক আব্দুল হাই সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অক্টোবর মাসেই কুড়িগ্রামে প্রবেশ করি। কিন্তু উলিপুর, চিলমারীসহ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধের কারণে শহরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ মিলে প্রায় ১৭ জন শহীদ হন। সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর আমাদের সঙ্গে তাদের আবারও যুদ্ধ শুরু হয়। চলে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে তারা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এসময় ৫ ডিসেম্বর বিমান থেকে পাক বাহিনীর ক্যাম্পের ওপর গোলাবর্ষণ করা হয়। এরপর ৬ ডিসেম্বর তারা কুড়িগ্রাম থেকে টোগরাইহাট এবং রাজারহাট হয়ে রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এসময় তারা রেলগাড়ি এবং পায়ে হেঁটে যেভাবে পারে পালিয়ে যায়। আমরা তাদের ওপর নজর রাখছিলাম। দুপুরের পর গেরিলা কমান্ডার হিসেবে আমার নেতৃত্বে হানাদারমুক্ত কুড়িগ্রাম শহরে আমরা প্রবেশ করি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমার হাতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত ৬টি পতাকা ছিল। আমি নিজেই নতুন শহরের ওভাররহেড পানির ট্যাংকের ওপর উঠে একটি পতাকা উড়িয়ে দেই। ট্যাংকের উপরে উঠে দেখি পাকবাহিনী সেখানে বালুর বস্তা দিয়ে ঘাঁটি বানিয়েছিল। ওর উপরে বসে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধ পর্যবেক্ষণ করতো। তাদের সেই বালুর বস্তার মধ্যেই পতাকা গেড়ে দিয়েছিলাম। এরপর কুড়িগ্রাম কলেজ, পিটিআই স্কুলসহ বিভিন্ন স্থান স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন আমাদের আনন্দের ভাষা ছিল ফাঁকা গুলি। আমরা গেরিলা যোদ্ধারা প্রথম কুড়িগ্রামে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে উৎসব করেছিলাম।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯৭১ সালে কুড়িগ্রাম জেলা ছিল ৮টি থানা নিয়ে গঠিত একটি মহকুমা। ১৯৭১ সালের ১০মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৭ মার্চ স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা চিলড্রেন পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মানচিত্র আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চের কাল রাতের পর সংগ্রাম কমিটি ২৮ মার্চ গওহর পার্ক ময়দানে জনসভা করে বেসরকারি হাইকমান্ড গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।

৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন কিছু সঙ্গী নিয়ে কুড়িগ্রামে চলে আসেন। তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১ এপ্রিল থেকে তিস্তা নদীর পূর্বপাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী দালালদের সহযোগিতায় তিস্তা নদী পাড় হয়ে লালমানিরহাট দখল করে নেয়। এরপর পাক বাহিনী ৭ এপ্রিল এবং ১৪ এপ্রিল দুই বার কুড়িগ্রাম দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শহর দখল করে নেয়।

এরপর থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে জুলাই মাস থেকে গেরিলা যুদ্ধ করে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে থাকে একের পর এক সফল অভিযান। ১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় পাকবাহিনী গণহত্যা চালায়। এদিন পাকবাহিনী পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭৩৪জন নিরীহ মানুষকে দাগারকুটি বধ্যভূমিতে জড়ো করে হত্যা করে। ১৪ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে জেলার ভূরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী, ৩০ নভেম্বর পুরো উত্তর ধরলা এবং ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরসহ গোটা জেলা হানাদার মুক্ত করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কুড়িগ্রাম জেলার অর্ধেক অংশ ছিল ৬নং সেক্টর এবং বাকি অংশ ছিল ১১নং সেক্টরের অধীনে। শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন রৌমারী থানা ছিল মুক্তাঞ্চল। সেখানেই চলতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কুড়িগ্রামকে হানাদার মুক্ত করতে শহিদ হন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা।

অপরদিকে, এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদাররা রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদারমুক্ত হয় এই অঞ্চল। ৭১’র ২৮ মার্চ কুড়িগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেত্বত্বে স্থানীয় গওহর পার্ক মাঠে এক বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখান থেকে আহম্মদ আলী বকসী, অধ্যাপক হায়দার আলী, তাছাদ্দুক হোসেন ও মহির উদ্দিন আহম্মদকে নিয়ে স্থানীয় কমান্ড গঠন করা হয়। তাদেরই নির্দেশে বিভিন্ন থানা থেকে গোলাবারুদ, অস্ত্র সংগ্রহ করে তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহম্মদ হোসেন সরকারের রাজারহাট উপজেলাধীন টগরাইহাট গ্রামের বাড়িতে অস্ত্র মজুদ করা হয়। এর পর ওই বাড়িতে স্থানীয় যুবক ও ছাত্রদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কলাকৌশল শেখানো হয়।

পরবর্তীতে রাজারহাট ওই বাড়ি থেকে প্রথমে পুলিশ-আনসার-ছাত্র ও স্থানীয় যুবকদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করে কুড়িগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করা হয়। ২৮ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গার এক বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে সংবাদ পাঠান রাজারহাট আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে। ২৯ মার্চ সকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিন আহমেদ, আছমত উল্লাহ ব্যাপারী ও আলী মনসুর সেখানে যান। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের সাথে বৈঠক শেষে কুড়িগ্রাম আওয়ামীলীগকে বিষয়টি অবগত করেন। ৩০ মার্চ ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নির্দেশে ওই উইং এর অধিনায়ক সুবেদার নুর মোহাম্মদ, সুবেদার আব্দুল মান্নান, সুবেদার আরব আলী ও বোরহান উদ্দিন তাদের সহযোদ্ধা ইপিআরদের নিয়ে রাজারহাট হয়ে কুড়িগ্রামে যান।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে তিস্তা ব্রিজের অপর পাশে মুক্তিযোদ্ধারা একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। এ সময় ইপিআর সদস্যরা রাজারহাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প তৈরি করে। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী হারাগাছ দিয়ে তিস্তা নদী পার হয়ে লালমনিরহাটে অবস্থান নিলে মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তার পূর্বপাড়ের ঘাঁটি রাজারহাট ও কুড়িগ্রাম নিয়ে আসেন। এরপর পাকবাহিনী দুই বার রাজারহাট আক্রমণ করে। মধ্য এপ্রিলে হানাদার বাহিনী রাজারহাট দখল করে নেয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজারহাট দখল করে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়িতে আগুন, লুটপাট, ধর্ষণ ও গণহত্যা চালায়।

অবশেষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিগ্রেডিয়ার যোশীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ষ্ঠ মাউন্টেড ডিভিশনের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই হানদারমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।

সারাবাংলা/জেজে/এজেড/এমও

কুড়িগ্রাম দেশ মুক্তি স্বাধীন

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর