কুবিতে অচল হয়ে পড়ে আছে ৫০ লাখ টাকার সোলার প্রকল্প
২৭ আগস্ট ২০২২ ০৮:০৮ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২২ ১৪:৫১
বর্তমানে দেশজুড়ে বিদ্যুতের বেশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই অনেক প্রতিষ্ঠানই বিদ্যুতের বিকল্প খুঁজছে। এদিকে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় স্থাপিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮টি প্যানেল বিশিষ্ট সোলার থাকলেও সেটি এখন অচল। ২০১১ সালে উদ্বোধনের এক বছরের মাথায় বৃহৎ এ প্রকল্পটি অচল হয়ে পড়ে। এরপর ১০ বছরেও সচল করার উদ্যোগ নেয়নি কেউ। অর্ধকোটি টাকার এ প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজে ব্যবহার না করতে পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ উঠেছে, অতীতে বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ দুর্নীতি করেছে বলেই এতো বড় একটি প্রকল্প আজ অচল হয়ে পড়ে আছে। আর তাই প্রকল্প শুরুর এক বছরের মাথায় নষ্ট হলেও প্রভাব খাটিয়ে ১০ বছরেও ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, এঈ বিষয়ে করা হয়নি কোনো তদন্ত কমিটিও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৪৯ লাখ ৬৯ হজার টাকা ব্যয়ে ৮.৪ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেয়। তবে প্রথম দিকে ৫ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল লাগানোর কথা থাকলেও ৮.৪ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল লাগানো হয়। তবে কিলোওয়াটের এই পরিবর্তন বিষয়ে নানা অনুসন্ধানেও কোনো কাগজ পাওয়া যায়নি।
এরপর এ ব্যাপারে চার সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ছয়টি মতামত প্রদান করে। এই বিশেষজ্ঞ প্যানেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক হিসেবে ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের। সেখানে তারা বাংলাদেশের আবহাওয়ার বিবেচনায় প্রতিটি প্যানেলে যেখানে ৬০টি করে সেল আছে সেখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৩৬টি অথবা ৭২টি করে সেল থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। ৬০টি করে সেল থাকার কারণে গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যাটারির চার্জিংয়ে সমস্যা হতে পারে বলে মত দেন তারা।
এছাড়া তিনটি চার্জ কন্ট্রোলারের মধ্যে দুটি (ডান পার্শ্বের) এমভিপি মুডে যায় কিন্তু বাম পাশের চার্জ কন্ট্রোলার স্টার্টআপ মুডে থাকলে এমভিপি মুডে না যাওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখ করেন। এসব কিছু ঠিক করে দিলে তখনই কাজ করে দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে বিল প্রদানের জন্য বলেন।
কিন্তু ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে পূর্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ সদস্যের গঠিত হওয়া টেকনিক্যাল সাব কমিটির সদস্য ও সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামানের উপস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরেজমিনে ঘুরে কোম্পানিকে তাদের নিরাপত্তা জামানত ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করেন এবং সোলারটি সন্তোষজনকভাবে কাজ করছে বলে জানান। এরপর তাদের এই সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ টাকা কোম্পানিকে দিয়ে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশল দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে ৫ কিলোওয়াটের কথা থাকলেও হুট করে পরিকল্পনা ছাড়াই ৮.৪ কিলো ওয়াটের সোলার লাগানো হয়েছে। যা শুধু প্রশাসনিক ভবন না বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনসহ সকল হলেও কভার করত। কিন্তু সে সময়ের প্রভাবশালী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক তাহেরের কারণে সেসব সম্ভব হয়নি। তাহের সাহেব একাই ৫৭টি কমিটিতে ছিলেন সেসময়। তিনিই কমিটিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন তাই এখানে দুর্নীতি হয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা-বানোয়াট কথাবার্তা। এগুলো চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই না। সোলার নষ্ট হওয়ার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এর আগে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ১০টি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে। সেখান থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করা হয়। এই ৫টি কোম্পানির মধ্যে ইন্ট্রাকো এনার্জি লিমিটেড, বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড শুধু টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন জমা দিয়েছিল। ফলে বাকি তিনটি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হয়নি। বাদ পড়া তিনটি কোম্পানির মধ্যে দেশের নামকরা একটি কোম্পানিও ছিল। সর্বশেষ সিলেটের বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড নামক একটি কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়। সেখানে এ কাজের বাজেট রাখা হয়েছে ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা এবং প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশল দফতরের আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্যানেলগুলো যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করত সেগুলো ইনভার্টারে জমা থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ অনুযায়ী ইনভার্টার ধারণ করার সক্ষমতা ছিল না। ফলে পরবর্তী সময় ইনভার্টার পুড়ে গেছে। আর এই ইনভার্টার সংস্কার করার কোনো উপায় নেই, নতুন করে কিনতে হবে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী এস. এম শহিদুল হাসান বলেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মো. আমির হোসেন খানের সময়ের ঘটনা। এটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ড. মো. আলী আশরাফ স্যার যখন ভিসি তখন আমরা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম,তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের ফাইলে ৩ বছরের সার্ভিস চার্জের কথা উল্লেখ আছে। সেটার পরিমাণ ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। ওই প্রতিষ্ঠান যদি সার্ভিস দেওয়ার জন্য আসত তাহলে তারা সার্ভিসের জন্য টাকা পেত। কিন্তু তারা সার্ভিস দিতেও আসেনি, টাকাও নেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদমর্যাদার এক শিক্ষক বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু তৎকালীন প্রশাসনের সঙ্গে আবু তাহেরের সখ্যতা থাকার কারণে সোলারের সব টাকা নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যয় করেছে। এদিকে প্রকল্পের কাজ করা কোম্পানি বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড সেসময় তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করে আর যোগাযোগ রাখেনি। এমনকি সার্ভিস চার্জও নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সার্বিক ঘটিনার ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আশরাফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরাই কুবিতে সোলার লাগিয়েছিলাম। লাগানোর এক বছর পর্যন্ত সময়ে যদি নষ্ট হতো তাহলে আমরা দায়িত্ব নিতাম। কিন্তু এক বছরের পরবর্তী সময়ে তো আমাদের দায়িত্ব থাকে না। তবুও আমরা দুয়েকবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গিয়েছিলাম এবং সমস্যা সমাধান করেছিলাম।
কাজ শেষে গত ১০ বছরেও সার্ভিস চার্জের টাকা কেন নেওয়া হয়নি, এমন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আশরাফ আহমেদ চৌধুরী বলেন,ওইদিকে আমাদের যাওয়া হয়নি তাই এসব টাকা আর নেওয়া হয়নি।
সোলার লাগানো কোম্পানি জামানতের জন্য আবেদন করলে অধ্যাপক তাহেরের সুপারিশে জামানতের টাকা পেয়েছিল এবং এর কিছুদিন পরই সোলার প্যানেল নষ্ট হয়। এ ব্যাপারে সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, আমার সই থাকতেই পারে, এতে কী হয়েছে? এরপর আরও কয়েকটি প্রশ্ন করলে তিনি এ ব্যাপারে তখন আর কথা বলতে রাজি হননি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, আমি এরকম একটি অভিযোগের কথা আগেও শুনেছি। আমি এই বিষয়ে খোঁজ নিব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।
তিনি আরও বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। কেউ যদি দুর্নীতি করে থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/এসএসএ