Friday 10 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

২০ বছর পর দিনমজুর মতিজার হত্যার বিচারের পথ ‍খুলল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৬ আগস্ট ২০২২ ০৯:০৭

ঢাকা: গাইবান্ধা জেলার ঘাগোয়া ইউনিয়নের রুপারবাজার গ্রামের দিনমজুর মতিজার রহমান (৩৭) হত্যা মামলায় বাদীর নারাজি আবদনের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতের দেওয়া আদেশ বাতিল করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর ফলে ২০ বছর পর মতিজার হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত হলো বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন এবং বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুল রাজ্জাক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল হাশেম।

বিজ্ঞাপন

রায়ের পর আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, এ রায়ের ফলে খুন হওয়ার দীর্ঘ ২০ বছর মতিজার রহমান হত্যার রহস্য উন্মোচনের পথ খুলল। এখন নিম্ন আদালতে মতিজার হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া পুনর্জীবিত হলো।

আইনজীবী সূত্রে ও মামলার বিবরণে জানা যায়, গাইবান্ধার ঘগোয়া ইউনিয়নের রুপারবাজার গ্রামের ধনিক মাহমুদ মতিজারকে লালন পালন করতেন। ধনিক মাহমুদ নিজের ছেলের মতো করেই মতিজারকে বড় করেন। মতিজার ধনিক মাহমুদকে বাবা হিসেবেই জানতেন। এলাকায় মতিজার পরিচিতি ছিলেন ধনিকের পালক ছেলে হিসেবে। মতিজার সাবালক হয়ে আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন। অন্যদিকে মতিজারের পালক বাবা ধনিক মাহমুদ মারা যান। পিতার মেয়েদের বোনের মর্যাদা দিয়ে স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন মতিজার। অভাবের তাড়নায় মতিজারের বোন প্রতিবেশি রবিজলের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। ২০০২ সালের প্রথম দিকে রবিজলের ছেলে ছলিমের দ্বারা মতিজারের বোন গর্ভবতী হয়ে পড়েন।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনায় মতিজার স্থানীয় মুরব্বিদের কাছে বিচার দাবি করেন। কিন্তু রবিজল, তার ছেলে ছলিমসহ তাদের সহযোগিরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনার বিচার দাবি করায় মতিজারের প্রতি রবিজল ও তার ছেলে ক্ষিপ্ত হয়ে মতিজারকে হুমকি দেয়।

এরপর ২০০২ সালের ১৩ মে রবিজলের লোকজন মতিজারকে বাড়ি হতে ডেকে নিয়ে যায়। পরদিন বাড়ি হতে তিন কিলোমিটার দূরে কালিরবাজার এলাকায় মতিজারের মৃতদেহ একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে পাওয়া যায়। এরপর গাইবান্ধার সদর থানা পুলিশ মতিজারের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠায়। ময়নাতদন্তে প্রতিবেদনে ডাক্তাররা উল্লেখ করেন— Death due to asphyxia Resulting of hanging. (ফাঁসিতে ঝুলে শ্বাসরোধে মৃত্যু)। এরপর রবিজলের লোকজনের যোগসাজসে তার ছেলে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে। কিন্তু একই সময়ে মতিজারের স্ত্রী আমেনা খাতুন থানায় হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে ২০০২ সালের ১৪ মে গাইবান্ধা সদর থানায় নিহতের স্ত্রী আমেনা খাতুন একটি অপমৃত্যর মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে পুলিশ একই বছরের ২৮ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

পরে একই বছরের ৬ জুন মতিজারের স্ত্রী আমেনা খাতুন বাদী হয়ে গাইবান্ধার আমলি আদালতে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে রবিজল, ছলিম, পাঞ্জু মিয়া, লাল মিয়া, ইদ্রিছ আলী ও আবদুল জলিলকে আসামি করে অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত বাদীর লিখিত অভিযোগ আমলে নিয়ে তা হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এ বিষয়ে গাইবান্ধা সদর থানাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু থানা পুলিশ মামলা রেকর্ড না করে নথি গায়েব করে ফেলে। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিপি, গাইবান্ধার এসপির কাছে নথির গায়েবের বিষয়টি জানিয়ে আবেদন করা হয়। এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বাদী আদালতে নথি তলবের জন্য দরখান্ত করা হয়। আদালত বাদী পক্ষের দেওয়া নথিপত্রের ফটোকপি নিয়ে মূল ভলিয়মের সঙ্গে মিলিয়ে এর সত্যতা পাওয়ায় নথি পুর্নগঠন করে দেন। একইসঙ্গে ওই নথি গাইবান্ধা থানাকে রেকর্ডভুক্ত করতে নির্দেশ দেন। এরপর থানা পুলিশ ডাক্তারি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি, ২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টম্বর, ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরসহ আদালতে কয়েকদফা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু বাদী পুলিশের এসব প্রতিবেদনে নারাজি দেন। ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দেওয়া বাদীর নারাজি আবেদন খারিজ করে ডাক্তারি প্রতিবেদনের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে পুলিশর দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে গাইবান্ধার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও আমলি আদালত ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রায় দেন। এরপর নারাজী আবেদনের নামঞ্জুরের বিরুদ্ধে গাইবান্ধার জ্যেষ্ঠ দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি রিভিশন দায়ের করলে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর ডাক্তারের মতামত ও তদন্ত কর্মকর্তার ‍সুপারিশ প্রাধান্য দিয়ে রিভিশন আবেদনটি নামঞ্জুর করা হয়। এরপর ওই আদেশের বিরুদ্ধে বাদী হাইকোর্টে ফৌজদারি বিবিধ মামলা দায়ের করেন।

বাদীর আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ১৫ জুন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন এবং বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট রুল জারি করে। ওই রুলে বলা হয়, গাইবান্ধার জ্যেষ্ঠ দায়রা আদালতের ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর দেওয়া বিতর্কিত রায় ও আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না? একইসঙ্গে রুলে আরও বলা হয়েছে, অত্র আদালতের বিবেচনায় বাদী ন্যায় বিচারের স্বার্থে আর যেসকল প্রতিকার পাইতে পারে, সে বিষয়েও কেন আদেশ দেওয়া হবে না, এই মর্মে রুল জারির নির্দেশ দেওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে গাইবান্ধার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

এরপর রুল শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন।

আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক বলেন, আজকের রায়ের ফলে বিচারিক আদালতের দেওয়া দুটি রায়, ডাক্তারের দেওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন বাতিল হলো। এরমধ্যে দিয়ে মামলাটি বিচারিক আদালতে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হলো।

তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তারের দেওয়া Un support ‍and without materials (শ্বাসরোধে আত্মহত্যা) মন্তব্য ছিল অবহেলামূলক মতামত। ডাক্তারের অবহেলামূলক মতামতের ভিত্তিতে বারবার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কারণে মামলাটির বিচার শুরু হতেই ২০টি বছর অপচয় হয়ে গেছে।

আইনজীবী আরও বলেন, আমি আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারিক আদালতে মামলাটি পুনর্জীবিত হবে। এ বিষয়ে নতুন করে সুষ্ঠু তদন্ত, চার্জগঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মতিজার রহমান হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে। আর ন্যায় বিচার পাবে মতিজার রহমানের পরিবার।

সারাবাংলা/কেআইএফ/এনএস

গাইবান্ধা টপ নিউজ দিনমজুর মতিজার হত্যা মতিজার রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর